অশ্রুসজল নয়নে উম্মে মুসা। কোলের শিশুকে ভাসিয়ে দিতে হবে কোন সুদূরের পর্বত থেকে নেমে আসা নীল দরিয়ায়। আদরের সন্তানকে পরম আদরে, সযতনে চাদরে জড়িয়ে জুড়িতে করে ভাসিয়ে দিলেন কোন এক গোপন কিনারায়। যার তরে ভাসতে হলো নীলে সেই নীলই পৌছে দিল শিশু নবীকে ফেরাউনের ঘাটে। ফেরাউনের ঘরে পরম আদরে পালিত হলো তার দম্ভনাশকারী খোদা তাআলার প্রতিশ্রুত নবী মুসা আঃ ।
নীল নদের শুরু কোথায়? নীল নদের বিস্ময়কর সৌন্দর্য ও সৌকর্যকে সমৃদ্ধ করেছে এই প্রশ্নটি। অন্তত তিন হাজার বছর ধরে এই প্রশ্নের উত্তর মানুষ খুঁজে চলেছে মানুষ। নীলের উৎস খুঁজতে অভিযান পরিচালনা করেছেন অনেক রথি-মহারথিগন। বিশেষ করে ১৯ শতকের বৈজ্ঞানিক অভিযান চালিয়েও নীলের উৎস সম্পর্কে ঘোর অন্ধকারে থাকতে হয়েছে বিজ্ঞানিদের । যে অন্ধকার এখনো পুরোপুরি কাটেনি।
নীল নদের ২টি উপশাখা রয়েছে। যার একটি হলো white nile বা শ্বেত নীল আর অপরটি হলো Blue Nile বা নীলাভ নীল নদ। নীলাভ নীল নদ ইথিওপিয়ার তানা হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়েছে এটা ঠিকঠাক উদ্ধার করা গেলেও White Nile বা শ্বেত নীল নদের উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে মানুষকে পড়তে হয়েছে নানা গোলক ধাঁদায়! এমনকি জীবনও দিতে হয়েছে অনেককে। অবশ্য শ্বেত নীল নদের উৎপত্তিস্থল হিসেবে তানজানিয়া, কেনিয়া এবং উগান্ডায় অবস্থিত আফ্রিকার বৃহত্তম জলধারা ভিক্টরিয়া রদকে বিবেচনা করা হয়।
বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে শ্বেত নীল নদ সুদানের রাজধানী খার্তুমে এসে মিলিত হয়েছে নীলাভ নীল নদের সাথে। তারপর একক নীল নদ মিসরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পতিত হয়েছে ভূমধ্য সাগরে।
দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় নীল নদকে পাড়ি দিতে হয়েছে অন্তত ১০টি দেশে ৬৬৯৫ কিলোমিটা দূরত্ব।
নীল নদের উৎপত্তিস্থল বহু আগেই সৃষ্টি হলেও ১৮৬২ সালে ভূগোলবীদ জন হেনিই সর্বপ্রথম এটি জনসম্মুখে নিয়ে আসে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ মে’রাজের রজনীতে জান্নাতে দু’টি দৃশ্যমান নদী দেখেছেন যার একটি হলো নীল নদ অপরটি ফোরাত নদী। সুতরাং আপাতদৃষ্টে নীল নদের উৎপত্তি লেক ভিক্টরিয়া বলা হলেও এর মূল উৎপত্তিস্থল জান্নাত।
অনন্য সাধারণ স্রোতধারা নীল নদ একসময় এতটা প্রবাহমান ছিল না। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই নদের পানি শুকিয়ে যেত। কথিক আছে তখন শোড়শি যুবতি নারিকে অলংকার পরিয়ে নাচ গাণের উৎসবের মাধ্যমে বলি দেয়া হলে আবার নীল নদে পানির প্রবাহ শুরু হত।
হিজরি ২০ সনে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর শাসনামলে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর নেতৃত্বে সর্ব প্রথম মুসলমানরা মিশর বিজয় করেন। মিশরে তখন চলছিল প্রবল খরা। কারণ নিয়ম অনুযায়ী সেই সময়টি ছিল নীল নদের পানি শূন্য হয়ে পড়ার সময়। সেসময় আমর ইবনুল আ’স রাঃ দেখেলেন তারা এক কুমারিকে বলি দিতে যাচ্ছে। সাহাবি রাঃ তৎখনাত এটি বন্ধের উদ্যোগ নিলেন এবং খলীফা উমর রাঃ এর নিকট পত্র পাঠালেন।
ইসলামের ২য় খলীফা উমর রাঃ নীল নদের নিকট একটি পত্র দিলেন যাতে লেখা ছিল
“আল্লাহর বান্দা আমীরুল মুমিনীন ওমর (রাঃ) এর পক্ষ হতে মিশরের নীল নদের প্রতি প্রেরিত এই পত্র। অতঃপর হে নীল নদ! তুমি যদি নিজের ক্ষমতা বলে ও নিজের পক্ষ হতে প্রবাহিত হয়ে থাক, তাহলে তুমি আজ হতে আর প্রবাহিত হয়ো না। তোমার কাছে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আর তুমি যদি মহা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর হুকুমে প্রবাহিত হয়ে থাক, তাহলে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন তোমাকে প্রবাহিত করেন”।
তিনি আমর ইবনুল আ’স রাঃ কে নির্দেশ দিলেন যাতে পত্রটি নীল নদের মাঝখানে এই চিরকুটটি রেখে দ্রুত চলে আসতে। আশ্চর্যের বিষয় হলো চিরকুটটি রেখে আসার পরদিন সকালে দেখা গেল নীল নদ সাধারণ সময়ের চেয়ে ১৬ ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেথেকে আজ পর্যন্ত এক মিনিটের জন্যও নীল নদ শুকিয়ে যায়নি।
নীল নদের উত্তরাংশের প্রায় পুরোটাই মিশরের মুরুভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই মিশরের সভ্যতা নীল নদের উপর নির্ভরশীল।
নীল নদের অববাহিকায় মিশরের অধিকাংশ জনসংখ্যার অবস্থান। প্রাচীন মিশরের সকল ঐতিহাসিক স্থাপনাই তৈরি হয়েছে নীল নদের তীরে।
হাজার হাজর বছর ধরে বয়ে চলা নীল নদ দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ১৯৭০ সালে মিশরে Aswan High Dam নামে একটি বাঁধ নির্মানের পর থেকে নীল নদে আর কোন বন্যা হয়নি। কারন এই বাঁধের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ কাজ ও বাসা বাড়িতে পানি সর্বরাহের মাধ্যমে নীল নদের প্রবাহকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করা হয়।
কালের পরিক্রমায় অসংখ্য মানুষের জিবীকার যোগান দিয়ে আসা নীল নদ আজ নিজেই নীঃস্ব। হাজার বছরের ইতিহাস ধারন করা নীল নদ শুকিয়ে যাওয়ার প্রধান কারন হলো মিশরে অত্যাধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বর্তমানে মিশরের জনসংখ্যা ১০ কোটির কাছাকাছি হলেও ধারনা করা হচ্ছে আগামী ৫০ বছরে মিশরের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে।
মিশরের জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষই নীল নদের পানির উপর নির্ভরশীল।
এছাড়াও নীল নদ একটি আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে এর উপর ১১টি দেশের অধিকার রয়েছে। এসব দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠি নীল নদের পানীর উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল।
আফ্রিকার ৩০ কোটিরও বেশী মানুষ নীল নদের পানির উপর সরাসরি নির্ভরশীল ।
এমন পরিস্থিতিতে মিশরসহ নীল নদের পানির উপর নির্ভরশীল অন্যান্য দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে সাথে বাড়তি পানির চাপও পড়েছে এই নদীর উপর।
নীল নদের পানি বন্টন নিয়ে এই নদী তীরবর্তী দেশগুলোর মধ্যে বেশ অসোন্তশও রয়েছে। নীল নদের পানি বন্টনে কে কতটুকু পাবে তা নিয়ে মিশর ও সুদানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই পানি বন্টন চুক্তি মোতাবেক প্রতি বছর মিশর পাবে ৫৫.৫ বিলিয়ন ঘনমিটার আর সুদান পাবে ১৫.৫ বিলিয়ন ঘনমিটার।
নীল নদে প্রবাহিত ৮০ শতাংশ পানি আসে ইথিওপিয়া থেকে। কিন্তু সে চুক্তিতে ইথিওপিয়া বা নীল নদ তীরবর্তী অন্যান্য দেশগুলোর কে কতটুকু পাবে তা উল্যেখ ছিলো না।
ফলে ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদার সাথে সাথে দেশগুলোর মধ্যে বাড়ছে অসোন্তশ!
বছরের পর বছর চেস্টার পরেও দেশগুলো কোন সমঝোতায় আসতে পারেনি।
নীল নদের মতোই দক্ষীণ এশিয়ার একাধিক নদীর পানি বন্টন নিয়েও রয়েছে অসোন্তশ। ভারত কর্তৃক গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলের পদ্মা নদী পরিনত হয়েছে একখন্ড মরুভূমিতে! সামপ্রতিক সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তার পানি প্রত্যাহারে নতুন করে আরও দুটি খাল কাটার খবরে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বহুল আলোচিত ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে নির্মিত তথ্যবহুল ভিডিওটি দেখতে আমাদের চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করে বেল বাটনে প্রেস করে রাখুন।
আরও পড়ুনঃ দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার ইতিহাস।