ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমৃত্যু আবু বকর রাঃ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যান্য সাহাবী রাঃ আনহুমদের থেকে অগ্রগামী ছিলেন। রাসূল সাঃ এর জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন ইসলামের আদর্শ সৈনিক। খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পরও ইসলামের উপর দৃঢ় ছিলেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহে সকল বাতিল শক্তিকে মোকাবেলা করে মুসলিম জাতীকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হন।
ইসলামের জন্য জীবনভর দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে রাসূল সাঃ এর মতো একই হায়াতে ৬৩ বছর বয়সে, সোমবার, ২২ জুমাদুল উখরা, ১৩ হিজরীতে ইনতেকাল করেন।আবু বক্কর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুর সংবাদে পুরো আরব উপত্যকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে, সেদিন মদীনার আবাল, বৃদ্ধা, বণিতা সকলে কান্না করেন।
আবু বকর রাঃ এর মৃত্যুর সংবাদ শুনে হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রাঃ দ্রুত ছুটে এসে আবু বকর রাঃ এর বাড়ির সামনে এক আবেগময় ভাষণ দেন। তাঁর এই সংক্ষিপ্ত ভাষনে আবু বকর আস-সিদ্দীক রাঃ এর পুরো জীবনি ফুটে উঠে। আলী রাঃ এর সেই আবেগময় ভাষনের বঙ্গানুবাদ theholymedia.com এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
আলী রাঃ তাঁর শোকবার্তায় বলেনঃ-
হে আবু বকর! আপনার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে নিকটতম সঙ্গী এবং বন্ধু ছিলেন। আপনি ছিলেন তার চোখের শান্তি; আপনিই তার সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি তার কোনো গোপন কথা থাকলে আপনাকে বলতেন এবং তার যদি কোন পরামর্শের প্রয়োজন হতো, তাহলে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। আপনি প্রথম ঈমান আনয়ন কারীদের একজন এবং আপনি দৃঢ় ঈমানের স্বাক্ষর রেখেছেন। অন্য যে কারো থেকে আপনার ঈমান ছিল শক্তিশালী।
একইভাবে আপনি সবার থেকে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতেন। আল্লাহ তা’আলার দ্বীনের জ্ঞানের দিক থেকে আমাদের মধ্যে আপনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি ধনী। আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলামের জন্য সবচেয়ে বেশি দরদী ছিলেন। সবার চেয়ে আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম সঙ্গী ছিলেন, আপনি উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন; আপনার অতীত ছিল গৌরবময়, আপনার মর্যাদা অনেক উপরে এবং আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুব প্রিয় ছিলেন। আপনি ইসলামের অনুসরণ ও আদর্শ বাস্তবায়নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
আমাদের যে কারো কাছ থেকে আপনার সম্মান ও মর্যাদা অনেক বেশি; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে সম্মান করতেন এবং যে কারো থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ইসলামের পক্ষ থেকে আল্লাহ তা’আলা আপনাকে যথাযথ পুরস্কার দান করুন। যখন সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবিশ্বাস করেছে, আপনি তখন তাঁর উপর ঈমান এনেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবদ্দশায, আপনি ছিলেন তার চোখ, যা দিয়ে তিনি দেখতেন, আপনি ছিলেন তার কান, যা দিয়ে তিনি শুনতেন, আল্লাহ আপনার বিশ্বস্ততার সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন
والذي جاء بالصدق وصدق به اولئك هم المتقون
যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে এবং সত্যকে সত্য মেনে নিয়েছে তারাই তো খোদাভীরু।
যখন লোকজন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহায্য করার ব্যাপারে চরম অনীহা প্রকাশ করেছে, আপনি তখন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। আর যখন লোকেরা অলস বসে ছিল আপনি তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পাশে থেকে একই কষ্টকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন। দুর্যোগ ও সংঘাতে আপনি ছিলেন তাঁর আদর্শ ও মহান সঙ্গী। আপনি ছিলেন হিজরতের সময় গুহায় দুজনের একজন এবং আপনি এমন একজন যার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সাকিনা নাযিল হয়েছে।
আপনি মদীনায় হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গী ছিলেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে ও মুসলিম জাতির জন্য আপনি তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে আপনি রাসুলের যথাযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। আপনি এমন সব ভালো কাজ করেছেন যা আপনার আগে রাসুলের অন্য কোন খলিফা করেনি। রাসুলের অন্যান্য সাহাবীরা দ্বীনের দুর্দশার সময় যখন আশা ছেড়ে দিয়েছিল এবং নরম আচরণ করেছিল তখন আপনি দৃঢ়তা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আর যখন তারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল তখন আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
আপনি সত্যিকার অর্থেই তেমন ছিলেন, যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “শারীরিক দিয়ে দুর্বল হলেও আল্লাহর আদেশ পালনের ব্যাপারে দৃঢ়, আচরণে বিনয়ী, কিন্তু আল্লাহর নিকট উঁচু মর্যাদাশীল; মানুষের দৃষ্টিতে অনুপ্রেরণার উৎস, সম্মানিত এবং হৃদয়ের মনি।”
আপনাকে অপছন্দ করার বিন্দুমাত্র কোন কারণ নেই। আপনার ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই অথবা আপনার সঙ্গে রাগ করারও কোনো যৌক্তিকতা নেই… আপনার দুর্বলতা ও সহনশীলতা সর্বদাই দৃঢ় ও সম্মানের কারণ ছিল, যা নিশ্চিতভাবেই সকলের প্রাপ্যকে সঠিকভাবে পরিশোধ করেছে।
এক্ষেত্রে আপনি আগন্তক এবং আত্মীয়ের সঙ্গে একই আচরণ করেছেন। যারা দ্বীনদার এবং আল্লাহকে বেশি ভয় পায় আপনি তাদের সম্মান করেছেন। আপনার সার্বিক চরিত্র ছিল সত্যবাদিতা এবং ধৈর্য।
আপনার খুতবা সব সময় গভীর প্রজ্ঞা ও দিকনির্দেশনায় পরিপূর্ণ ছিল। আপনি সর্বদা বিনয় দৃঢ়তার ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। আপনি প্রজ্ঞাময় সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং একবার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তা বাস্তবায়নে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন… অবশ্যই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁরই দিকে ফিরে যাব। আমরা এতেই সন্তুষ্ট এবং আমরা আল্লাহর সিদ্ধান্তের নিকট নিজেদের ন্যস্ত করছি।
আল্লাহর শপথ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের পর মুসলিম জাতি আপনার মৃত্যুর মত এরকম দুর্দিনের সম্মুখীন হয়নি। আপনি ইসলামের রক্ষক আদর্শ এবং সম্মানের উৎস ছিলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলের সঙ্গে আপনার মিলনকে বরকতময় করুন এবং আপনাকে যথাযোগ্য পুরষ্কার দান করুন। আপনার পরে আমাদের যেন আল্লাহ তা’আলা দ্বীনের পথে অবিচল রাখেন। এই আবেগি ভাষণ দেওয়ার সময় লোকজন আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর চারিদিকে এসে জমা হতে লাগল এবং শেষ হওয়া পর্যন্ত তার বক্তব্য মনোযগ দিয়ে শুনল।
তারপর তারা উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল এবং সবাই একযোগে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্যে একমত পোষন করে বলে উঠল আপনি সত্য বলেছেন।
ওলামায়ে কেরাম সবাই এ বিষয়ে একমত যে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মত একই হায়াত পেয়েছিলেন। ওসিয়াত অনুযায়ী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা গোসল করান। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর জানাজার নামাজের ইমামতি করেন।
ওমর ইবনুল খাত্তাব, উসমান ইবনে আফফান, তালহা, এবং আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাঁকে কবরে নামান।
আল্লাহ সকল সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুম দের উপর রহম করুন এবং আমাদেরকে তাদের আদর্শ অনুযায়ী ইসলামের পথে দৃঢ়তার সাথে চলার তাওফীক দান করুন আমীন।
আরো পড়ুনঃ