মনপুরা দ্বীপ প্রকৃতির অপার সৃষ্টি অন্যান্য দ্বীপদেশগুলোর মত জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও, বাংলাদেশের উপকূলগুলো মোটেই বঞ্চিত হয়নি প্রাকৃতিক শোভা থেকে। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এই ব-দ্বীপের আঙ্গিনা সযত্নে ধুয়ে দিয়ে যায় বঙ্গোপসাগরের ফেনিল জলরাশি। সামুদ্রিক হাওয়ার পরশে পলিমাটির অলঙ্করণে যেন নিয়ত সেজে থাকে কাঁচা জীবনধারার ঘনবসতিগুলো।
২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সফল চলচ্চিত্র মনপুরা ঠিক যেন এমনি এক কাদামাটি তুলে এনেছিল সাগরের বুক থেকে। এরপর থেকে খুব সহজেই চলচ্চিত্রপ্রেমী, ভ্রমণপিপাসুদের হৃদয় জয় করে নেয় প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের মনপুরা দ্বীপ । বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগসূত্র না থাকলেও তারা ছুটে গেছেন এই দ্বীপ সৈকতে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণের আদ্যোপান্ত।
বঙ্গোপসাগরের উত্তর দিকে মেঘনা নদীর মোহনায় ৩৭৩ বর্গ কিলোমিটার জায়গা নিয়ে জেগে আছে মনপুরা দ্বীপ। বরিশালের ভোলা জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন স্থলভাগটির তিন দিকে মেঘনা আর একদিকে বঙ্গোপসাগর। ভোলা জেলার প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত মোট চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এক উপজেলা মনপুরা দ্বীপ।
মনপুরা দ্বীপ নামের পটভূমি
দ্বীপের নাম কীভাবে মনপুরা হলো সে নিয়ে অনেক মতভেদ থাকলেও স্থানীয় বায়োজ্যেষ্ঠদের মতে, দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্য ও উপকূলবর্তী খাবার আগন্তুকদের মন জয় করত। এ কারণেই এর নাম মনপুরা দ্বীপ হয়েছে।
আবার অনেকের ধারণা, মনগাজী শাহবাজপুর জমিদারের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া হয়েছিল বিস্তৃত এই জায়গাটি। ফলে তার নামের ওপর ভিত্তি করেই এলাকার নামকরণ করা হয়েছে।
এছাড়াও একটি অদ্ভূত গল্পও প্রচলিত আছে এ দ্বীপকে ঘিরে। জায়গাটিতে আগে বাঘ ও হাতির মত জন্তু-জানোয়ার বিচরণ করত। এক সময় মনগাজী নামের এক লোক বাঘের আক্রমণে শিকার হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারান। সেই থেকে সবাই এটিকে মনপুরা দ্বীপ নামে ডাকতে শুরু করে।
মনপুরা দ্বীপের মূল আকর্ষণ
মনপুরার আকর্ষণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে প্রথমেই আছে মাইলের পর মাইল সবুজ ম্যানগ্রোভ বাগান। দক্ষিণের চির সতেজ বনের চারপাশ ঘিরে রয়েছে নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মনোরম ঢেউ।
উপজেলা ঘুরে দেখার সময় পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে উপজেলা পরিষদের ৫ দিঘী এবং চৌধুরী ফিসারিজ প্রজেক্ট। মেঘনা নদীর উপর দিয়ে ৫০০ মিটার দীর্ঘ মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশনটি সেখানকার বেশ জনপ্রিয় স্থান। বিকাল থেকে শুরু করে রাত অবধি এখানে দ্বীপবাসী ও ভ্রমণকারীদের ভিড় হয়।
আলমনগর কেওড়া বনে নদীর পার ধরে ভিড় করা হরিণের পাল আলাদাভাবে মন ভরিয়ে দেয় ভ্রমণকারীদের। জোয়ারের সময় হরিণগুলো মুল সড়কের একদম কাছাকাছি চলে আসে। কখনও এমন অবস্থা হয়, এদের নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হওয়ার জন্য গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
এ ছাড়া, মনপুরার চরগুলো শীতের মৌসুমে বিচিত্র ধরনের অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকে। মনপুরা দ্বীপ জুড়ে রয়েছে ছোট-বড় সব মিলিয়ে মোট ১০টি চর। এগুলো হলো- চর মুজাম্মেল, চর পাতালিয়া, চর নিজাম, চর পিয়াল, লালচর, চর শামসুউদ্দিন, ডাল চর, কলাতলীর চর ও চর নজরুল।
কুয়াকাটার মত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য মনপুরা দ্বীপের খ্যাতি রয়েছে। জনবসতির মাঝে দেখা যায় বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত পুকুর, যাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে সারি সারি নারকেল গাছ।
যারা সাইক্লিং ভালোবাসেন তাদের জন্য মনপুরা দ্বীপ সেরা জায়গা। এ ছাড়া সবুজের সমারোহে ক্যাম্পিং করা যেকোনো হোটেলে রাত্রিযাপনের দারুণ বিকল্প হতে পারে এই দ্বীপ।
মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণের সেরা সময়
মনপুরা দ্বীপ মন ভরে ঘুরতে হলে আসতে হবে শীতকালে। কিছুটা শুষ্ক থাকায় ঠান্ডা মৌসুমে সাইক্লিং ও তাঁবু খাটানোর আনন্দটা পুরোটাই পাওয়া যাবে। পাশাপাশি শীতকালে বিরল সব অতিথি পাখি দর্শনের সুযোগ থাকে । অন্যান্য মৌসুমগুলোতে বিশেষ করে বর্ষার সময় এখানে আসার সমুদ্র পথটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকা থেকে মনপুরা দ্বীপ যাওয়ার উপায়
ভোলা শহরের স্থলভাগের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগসূত্র না থাকায় এই দ্বীপে পৌঁছানোর একমাত্র বাহন হচ্ছে লঞ্চ ও ট্রলার।
এজন্য প্রথমে ঢাকার সদরঘাট থেকে হাতিয়ার লঞ্চে উঠতে হবে। লঞ্চগুলো প্রতিদিনি বিকাল ৫টায় ছাড়ে এবং পরদিন সকাল সাড়ে ৭ টার মধ্যে মনপুরা পৌঁছায়।
১২ থেকে ১৩ ঘন্টার এই দীর্ঘ যাত্রায় লঞ্চের ডেক ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৩৫০-৪৫০ টাকা। নন-এসি সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং ডাবল কেবিন ভাড়া ২ হাজার টাকা বা তারও একটু বেশী। ডিলাক্স ডাবলের জন্য খরচ করতে হবে ৩ থেকে চার হাজার টাকা, যেখানে ভিআইপি কেবিনে পড়বে ৫-৬ হাজার টাকা।
তবে এখন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বিলাসবহুল বাসেও ঢাকা-ভোলা যাতায়াত করা যায়।
ফেরার সময় সরাসরি ঢাকার পথ ধরতে হলে মনপুরার রামনেওয়াজ লঞ্চঘাটে দুপুর ২টার আগেই উপস্থিত থাকতে হবে।
আরেকটি পথ হচ্ছে, ঢাকা থেকে বরিশালের ভোলা হয়ে যাওয়া।
ভোলার চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাট থেকে মনপুরার লঞ্চ আছে, যেটি জনতা বাজারে থামে। এই পথটি এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত আবহাওয়া প্রতিকূল থাকার কারণে বন্ধ থাকে।
দ্বীপের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার উপায় হলো অটোরিকশা, রিকশা, মোটর বাইক, বোরাক ও সাইকেল। এক মোটরসাইকেলে পুরো দ্বীপ ঘোরার জন্য খরচ পড়তে পারে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
মনপুরা দ্বীপে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
এখানে রাত্রিযাপনের জন্য রয়েছে উপজেলা সরকারি ডাকবাংলো, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভবন এবং কিছু বেসরকারি হোটেল।
সরকারি ডাকবাংলো ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভবনে থাকার জন্য যথারীতি আগে থেকেই অনুমতি নিতে হবে। এগুলোতে বেশ স্বল্প খরচে রাত কাটানো যাবে।
অন্যান্য হোটেলে রুম ভাড়া নিতে পারে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো।
মনপুরা দ্বীপে ভ্রমণকালীন প্রয়োজনীয় সতর্কতা
গত কয়েক বছর ধরে দ্বীপটি ভূমি ক্ষয়ের প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্ষাকাল এড়িয়ে শীতকালে এলেও দ্বীপে ঘুরে বেড়ানোর সময় সতর্ক থাকতে হবে। এ জন্য ভোলা; সম্ভব হলে ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার সময়েই দ্বীপের বর্তমান অবস্থার কথা জেনে নিন।
- নদী ভ্রমণের সময় লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিন।
- ভ্রমণকালে যেকোনো বিষয়ে লেনদেনের আগে ভালোভাবে দরদাম করে নেওয়া উচিত।
- দলগতভাবে ভ্রমণে খরচ বাঁচে এবং নিরাপত্তাও জোরদার হয়। এরপরেও অতিরিক্ত সাবধানতার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের যোগাযোগ নাম্বারগুলো সংগ্রহে রাখুন।
- পাশাপাশি স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন, এতে নানা বিপদে-আপদে তারা এগিয়ে আসবে।
- দ্বীপের পরিবেশ ও সৌন্দর্য রক্ষার্থে সতর্ক থাকুন। এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যেখানে প্রকৃতি ও দ্বীপবাসীর ক্ষতিসাধন হয়।
মনে রাখবেন
যেখানে জনস্রোতের কোলাহল থেমে যায়, সেখানে সরব হয়ে ওঠে প্রকৃতির কন্ঠস্বর। এমনি নির্জনতায় তাঁবু থেকে সাগরের গর্জনে ঢাকা পড়তে পারে হরিণের পালের পায়চারির শব্দ। এরসঙ্গে ম্যানগ্রোভ গাছের বৈঠকী সংগীত মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণ ষোলো আনা পুষিয়ে দিতে পারে। তখন সাইকেলে চেপে পুরো দ্বীপ ঘুরতে গিয়ে সৈকতে চাকা আটকে যাবার বিরক্তিটাও সযত্নে তোলা থাকবে স্মৃতির মণিকোঠায়। বাড়ি ফেরার পর সে স্মৃতি তাড়না দেবে জানালার ওপারে দিগন্তরেখায় কোনো অর্ধচন্দ্রাকার ডিঙ্গি নৌকা খোঁজার।
আরও পড়ুনঃ মানুষ্য সৃষ্ট সৌন্দর্যের লীলাভূমি কাপ্তাই লেকের ইতিহাস