আজান হলো ইসলামের পাঁচ স্তম্বের অন্যতম ফরজ বিধান নামাজ আদায়ের জন্য আহ্বান। মহান আল্লাহ তা’আলার ইবাদত-বন্দেগি ও হুকুম আহকাম পালনের জন্যই আজান দেওয়া হয়। ইসলামে আজানের উপকারিতা ও মুয়াজ্জিনের মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক বেশি।মুয়াজ্জিন ও আজানের জবাবদাতা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।
আবদুল্লাহ ইবন ইউসুফ (রহ.) আবদুল্লাহ ইবন আবদুর রহমান আনসারী মাযিনী (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন যে, আবূ সায়ীদ খুদরী (রা.) তাকে বললেন, আমি দেখছি তুমি বকরি চরানো এবং বন-জঙ্গলকে ভালোবাস। তাই তুমি যখন বকরি চরাতে থাক, বা বন-জঙ্গলে থাক এবং নামাজের জন্য আজান দাও, তখন উচ্চকন্ঠে আজান দাও। কেননা, জিন, ইনসান বা যেকোনো বস্তুই যতদূর পর্যন্ত মুয়াজ্জিনের আওয়াজ শুনবে, সে কিয়ামতের দিন তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। আবূ সায়ীদ (রা.) বলেন, একথা আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে শুনেছি। (বুখারী শরীফ বাংলা সংস্করণ- ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ৫৮২)
আজানের জাবাব দেওয়া ওয়াজিব বা ফরজ নয়। বস্তুত সাক্ষ্য দেওয়া সবারই কাজ নয়। অবিশ্বস্ত ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয় না। যার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে তার প্রিয় হতে হবে আর যিনি দেবেন তাকেও প্রিয় হতে হবে। যদি উভয়েই প্রিয় হয় তাহলে মহান আল্লাহপাকও তাদের সাক্ষ্য প্রিয় হিসেবে গ্রহণ করবেন। আর যদি প্রিয় না হয় তাহলে তাদের সাক্ষ্যও মহান আল্লাহপাকের দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না। যে ব্যক্তি নিয়মিত আজানের জবাব দিতে থাকবে সে ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বমহূর্তে হলেও গুনাহমুক্ত হবে এবং মৃত্যুর পর মহান আল্লাহপাক তার সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন।
আজানের উত্তর দেয়া কি ওয়াজিব?
একটি হাদিস শরিফে মহানবী সা. বলেছেন, আজান শুনলে মুয়াজ্জিন যা বলে তাই বলো। এ ধরনের আরো হাদিস আছে। সব হাদিসের আলোকে এ বিষয়ে পূর্ণ সুন্নত আমল হলো নিম্নরূপ : মুয়াজ্জিনের মতোই প্রতিটি বাক্য মনে মনে উচ্চারণ। হাইয়া আলাস সালাহ ও হাইয়া আলাল ফালাহ-এর স্থলে বলতে হবে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’। মুয়াজ্জিন সাহেব ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বলার সময় ঠিক এ কথাটিই শ্রোতাকেও বলতে হবে। শুধু ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ বললে হবে না। আজান শেষে মুয়াজ্জিনের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এরপর শ্রোতাকে বলতে হবে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’। এরপর আলাদা করে আবার দরূদ শরিফ পড়া সুন্নত। সবশেষে আজানের দোয়া। আজানের জবাব মুখে দেয়া সুন্নত, তবে এর মূল জবাব হলো জামাতে শরিক হওয়া। কোনো জরুরি কাজের সময় জবাব না দিতে পারলেও গোনাহ নেই। পেশাব-পায়খানা করা অবস্থায় জবাব দেয়া উচিত নয়। দীনি কাজে ব্যস্ত অনেক মানুষের মধ্যে একজন জবাব দিলেও আদায় হয়ে যায়। সূত্র : জামেউল ফাতাওয়া, ইসলামী ফিক্হ ও ফাতাওয়া বিশ্বকোষ।
আজানের জবাবের ফজিলত:
আবদুল্লাহ ইবন ইউসুফ (র.) আবূ সায়ীদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন তোমরা আজান শুনতে পাও তখন মুয়াজ্জিন যা বলে তোমরাও তার অনুরুপ বলবে। (বুখারী শরীফ বাংলা সংস্করণ- ইসলামিক ফাউন্ডেশন: হাদিস/৫৮৪)
ইবনুস (সারহ রহ.) আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) হতে বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর বলেন, এক ব্যক্তি বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ! মুয়াজ্জিনরা তো আমাদের ওপর ফজিলত প্রাপ্ত হচ্ছে (আমাদের চেয়ে বেশি সওয়াবের অধিকারী হচ্ছে)। আমরা কিভাবে তাদের সমান সওয়াব পাব? তিনি বলেন, মুয়াজ্জিনরা যেরুপ বলে, তুমিও তদ্রুপ বলবে। অত:পর যখন আজান শেষ করবে, তখন আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলে তুমিও তদ্রুপ সওয়ার প্রাপ্ত হবে। (সহীহ আবু দাউদ- ইসলামিক ফাউন্ডেশন: হাদিস/৫২৪)
মুহাম্মাদ ইবনুল মুছান্না (রহ.) উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন মুয়াজ্জিন আজানের সময় আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার বলবে, তখন তোমরাও আল্লাহু আকবার বলবে। অত:পর মুয়াজ্জিন যখন আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে তখন তোমরাও আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে। অত:পর মুয়াজ্জিন যখন আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ বলবে তখন তোমরাও আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ বলবে। অত:পর মুয়াজ্জিন যখন ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ বলবে তখন তোমরা বলবে, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। অত:পর মুয়াজ্জিন যখন ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ বলবে তখন তোমরা বলবে লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। অত:পর মুয়াজ্জিন যখন আল্লাহু আকবার বলবে তখন তোমরা আল্লাহু আকবার বলবে, অত:পর মুয়াজ্জিন যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে, তখন তোমরাও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে। তোমরা যদি আন্তারিকভাবে এরুপ বল তবে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সহীহ আবু দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: হাদিস/৫২৭)
মুহাম্মাদ ইবন সালামা (রহ.) আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি নবী করীম (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, যখন তোমরা মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে শুনবে তখন সে যেরুপ বলে, তোমরাও তদ্রুপ বলবে। অত:পর তোমরা (আজান শেষে) আমার প্রতি দরুদ পাঠ করবে। কেননা যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার ওপর দশটি রহমত নাজিল করবেন। অত:পর তোমরা আল্লাহর নিকট আমার জন্য ওসীলা প্রার্থনা কর এবং ওসীলা হলো জান্নাতের একটি বিশেষ স্থান। আল্লাহ তাআলার একজন বিশিষ্ট বান্দা ওই স্থানের অধিকারী হবেন এবং আমি আশা করি আমিই সেই বান্দা। অত:পর যে ব্যক্তি আমার জন্য ওসীলার দোয়া করবে তার জন্য শাফাআত করা আমার ওপর ওয়াজিব হবে। (সহীহ আবু দাউদ- ইসলামিক ফাউন্ডেশন: হাদিস/৫২৩)
আজানের জবাব দেওয়ার পদ্ধতি:
(১) আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার
জবাব: আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার
(২) আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
জবাব: আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
(৩) আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ
জবাব: আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ(‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’), আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ (‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’)
(৪) হাইয়া আলাছ ছালা-হ
জবাব: লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াত্তা ইল্লা বিল্লাহ
(৫) হাইয়া আলাছ ছালা-হ
জবাব: লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াত্তা ইল্লা বিল্লাহ
(৬) হাইয়া আলাল ফালা-হ
জবাব: লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াত্তা ইল্লা বিল্লাহ
(৭) হাইয়া আলাল ফালা-হ
জবাব: লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াত্তা ইল্লা বিল্লাহ
(৮) আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার
জবাব: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার
(৯) লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ —লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ
জবাব: লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ —লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ
(১০) আজান শেষে মুয়াজ্জিনের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এরপর শ্রোতাকে বলতে হবে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’।
(১১) ফজরের আজানের সময় ‘হাইয়া ‘আলাল ফালা-হ’ এর জবাবে ‘ছাদাক্বতা ওয়া বারারতা’ বলবে।
আজানে পর দোয়া ও দরূদ পড়বেন কেন?
হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের আজান শুনে বলবে-
وَ اَنَا اَشْهَدُ اَنْ لَا اِلهَ اِلَّا اللهُ – وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ – وَ اَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَ رَسُوْلُهُ – رَضِيْتُ بِاللهِ رَبًّا – وَ بِالْاِسْلَامِ دِيْنَا – وَبِمُحَمَّدٍ رَسُوْلَا
উচ্চারণ : ওয়া আনা আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু, রাদিতু বিল্লাহি রাব্বান, ওয়া বিল ইসলামি দিনান, ওয়া বিমুহাম্মাদিন রাসুলান’ আল্লাহ তাআলা তার গোনাহ মাফ করে দেন।’ (তিরমিজি, মুসলিম, ইবনে মাজাহ)
অন্য আরেক হাদিসে বর্ণিত আছে যে, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের আজানের পর প্রচলিত দোয়াটি পাঠ করবে, তার জন্য প্রিয়নবি শাফায়াত করবে। অথচ আমাদের অনেকেই আজান শুনে ঠিকই; অলসতা বা খেয়ালের ভুলে উত্তর দেয়া থেকে যেমন বিরত থাকে; তেমনি দরূদ ও দোয়া পড়া থেকেও বিরত থাকে।
হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আজান শুনে বলে-
اَللَّهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ – وَالصَّلَاةِ الْقَائِمَة – اتِ مُحَمَّدَانِ الْوَاسِلَةَ وَ الْفَضِيْلَةَ – وَابْعَثْهُ مَقَامًا مَّحْمُوْدَانِ الَّذِىْ وَعَدْتَه
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা রাব্বা হাজিহিদ দাওয়াতিত তাম্মাহ, ওয়াস-সালাতিল কায়িমাহ, আতি মুহাম্মাদানিল ওয়াসিলাতা ওয়াল ফাদিলাহ, ওয়াবআছহু মাকামাম মাহমুদানিল্লাজি ওয়া আদ্তাহ’ তার জন্য কেয়ামতের দিন আমার শাফায়াত ওয়াজিব হবে।’ (তিরমিজি, বুখারি, ইবনে মাজাহ)
এ আমলটি মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই সহজ। শুধু তাই নয়, কোনো ব্যক্তি যদি আজানের পর দোয়ার আগে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ পাঠ করে; তার জন্যও প্রিয়নবির সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে যায়।
মুয়াজ্জিনের ফজিলত:
রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন যে, ‘ক্বিয়ামতের দিন মুয়াজ্জিনের গর্দান সবচেয়ে উঁচু হবে’। (মুসলিম, মিশকাত হাদিস/৬৫৪।)
মুয়াজ্জিনের আজান ধ্বনির শেষ সীমা পর্যন্ত সজীব ও নির্জীব সকল বস্তু তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে ও সাক্ষ্য প্রদান করে। ওই আজান শুনে যে ব্যক্তি নামাজে যোগ দিবে, সে ২৫ ওয়াক্ত নামাজের সমপরিমাণ নেকি পাবে। মুয়াজ্জিনও উক্ত মুসল্লির সমপরিমাণ নেকি পাবে এবং তার দুই আজানের মধ্যবর্তী সকল (সগীরা) গুনাহ মাফ করা হবে’। (নাসাঈ, আহমাদ, মিশকাত হা/৬৬৭।)
যে ব্যক্তি ১২ বছর যাবত আজান দিল, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেল। তার প্রতি আজানের জন্য ৬০ নেকি ও এক্বামতের জন্য ৩০ নেকি লেখা হয়’। (ইবনু মাজাহ, মিশকাত হাদিস/৬৭৮।)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আজানের ফজিলত পরিপূর্ণভাবে বুঝার তাওফিক দান করুন। আজানের পর উল্লেখিত দোয়া ও দরূদগুলো আদায় করার মাধ্যমে গোনাহমুক্ত জীবন লাভের তাওফিক দান করুন। পরকালে প্রিয়নবি সাঃ এর সুপারিশ লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
আরো পড়ুনঃ ফজরের সুন্নত পড়তে না পারলে করণীয়