আমার দ্বীনে ফেরার গল্প; ২০১৪ সালের মার্চ মাস। এসএসসি পরিক্ষা শেষ করে বেকার দিন যাচ্ছিলাে তাই ইংরেজি ও কম্পিউটার শেখার জন্য কোচিং এ ভর্তি হলাম। এরিয়াটা পরিচিত হওয়ায় সবাই দেখে ফেলবে তার জন্য বােরকা পরা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে আল কুরআন নিয়ে বসা হতাে তখন, তাফসীরসহ এক বা দেড় পৃষ্ঠা পড়াতাম। অবসরে পড়ার জন্য কিছু বই কিনে আনলাম। যার মধ্যে ছিল ‘চার খলিফার জীবনী’, মেরাজ এর ঘটনা সম্পর্কে বই।
এইভাবে নিজের অজান্তেই দ্বীনের দিকে ফেরার পথে পা বাড়াই। যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন,
“যে ব্যক্তি আমার দিকে এক বিঘত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত পরিমাণ অগ্রসর হই। যে আমার দিকে এক হাত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দুই হাত পরিমাণ অগ্রসর হই। আর সে যখন আমার দিকে হেঁটে অগ্রসর হয়, আমি তখন তার দিকে দৌড়ে অগ্রসর হই।”
জুন বা জুলাই মাস। অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য। পড়ালেখায় তেমন এ+ পাওয়ার মতাে অবস্থা না হলেও একদম অকৃতকার্য হওয়ার মতােও অবস্থা ছিলাে না। মাঝামাঝিতে ছিলাম। অবশেষে আসলাে সেই কাঙ্খিত দিন। সেদিন যুহরের নামাযে দাড়াই। মনে মনে জানতাম রেজাল্ট ভালােই হবে। বােন এর একটা কল আমার সব কিছু উলট পালট করে দিলাে। নামাজে আমার মুখ থেকে কিছুই বের হচ্ছিলাে না শুধু চোখের পানি ছাড়া।
তখনও আমি জানতাম না এই রেজাল্ট ই আমার হেদায়াত এর মাধ্যম হবে। আমার রব আমার জন্য উত্তম পরিকল্পনা করে
রেখেছেন।
আলহামদুলিল্লাহ। আমি অকৃতকার্য হই। সেইদিন নামাজে দাড়িয়ে কেঁদে কেঁদে এতাে দোয়া করেছি যে আমার রব ফিরিয়ে দেন নি। তার জন্য আল্লাহর প্রতি শুকরিয়ায় সিজদাবনত হয়ে বলি,
“হে আমার রব আপনাকে ঢেকে আমি কখনাে নিরাশ হইনি প্রভু।”
আমার জন্য তখন এক বছর আমার কিছুই করার ছিলাে। জীবনটা কেমন বদলে যেতে শুরু করলাে। “চার খলিফার জীবনী ও মেরাজ সম্পর্কিত বই” অনেকটা অনুপ্রেরণা ছিলাে।
বই গুলাে পড়তাম আর একটু একটু করে চিন্তা করতাম ইসলাম নিয়ে, নবী (সাঃ) কে নিয়ে, জান্নাত জাহান্নাম নিয়ে। কি উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় এসেছি! ততদিনে নিয়মিত নামায পড়া শুরু করি।
এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় ফেইসবুক ছিলাে আমার হেদায়েত এর পরবর্তী দিক নির্দেশক। এখানে কিছু দ্বীনি বােন পেলাম।(আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন) ও ইসলামিক গ্রুপে জয়েন হলাম। দ্বীন সম্পর্কে প্রতিনিয়ত নতুন অনেক কিছু জানতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে নিজেকে রাসূল (সাঃ) এর দেখানাে পথে পরিচালিত করতে শুরু করলাম।
সেলফি পাগলী মেয়েটা যখন জানতে পারলাে বিনা কারণে ছবি তােলা নিষেধ তখন খুব মন খারাপ করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সব জায়গা থেকে তার ছবি ডিলিট করে দেয়। আর যাদের কাছে গ্রুপ ছবি ছিলাে তাদেরও অনেক রিকুয়েষ্ট করে সেগুলাে ডিলিট করাই। হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস আর জাফর ইকবালের সাইন্স ফিকশনের বই গুলাে ফেলে ইসলামি বই পড়তে শুরু করি।
বান্ধবীদের উপহার হিসেবে অনেক পুতুল গিফট করি, তাদের বলে সেগুলাে নষ্ট করে ফেলতে আর এর বদলে অন্য কিছু হাদিয়া দেই। আলহামদুলিল্লাহ আমার বান্ধবীরা নিজে দ্বীন না মানলেও কখনাে আমাকে এসব নিয়ে কটু কথা বলে নি। আমার সব কথাই মেনে নিয়েছিলাে তারা বিনা বাক্যে। এই জিনিসটাই আমাকে বিশ্বাস করায় যে, “আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে কাজ করা হয় তা এমনিতেই আল্লাহ রব্বুল আল-আমিন সহজ করে দেন। ”
খুব করে ইচ্ছে হতাে এলাকায় যদি একটা মাদ্রাসা হতাে যেখান থেকে আমি দ্বীনি শিক্ষা নিতে পারি! কিন্তু আমদের এখানে এমন কোনাে মাদ্রাসাই ছিলাে না। কলেজে ভর্তি হই। ততােদিনে পর্দা করে ক্লাস করাও শুরু করি। কলেজ শেষ করে পর্দা করতে সমস্যা হবে দেখে দুনিয়াবি শিক্ষার ইতি টানি।
ইসলামী বই ছিলাে তখন একমাত্র মাধ্যম। দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের জন্য ইসলামিক বই গুলাে পড়তাম। এইভাবেই অনেক গুলাে বছর কেটে গেলাে। তারপর ফেইসবুক এর মাধ্যমে জানতে পারলাম অনলাইন অনেক মাদ্রাসার কথা। ফ্রেন্ড লিস্টের কয়েকজন আপুকে দেখলাম IOM-তে পড়ছেন। সেখান থেকেই IOM এ ভর্তি হওয়ার চিন্তা মাথায় আসে। কিন্তু ততদিনে আমার শেখার ইচ্ছায় কেমন যেন ভাটা পড়ে গেলাে। ভর্তি হবাে হবাে করে ভর্তি হচ্ছিলাম না। কেমন যেন গাফিল হয়ে যাচ্ছিলাম। আল্লাহুমাগফিরলী।
সব সময় দোয়া করতাম,
“ইয়া রব আমি তাে পথহারা ছিলাম আপনিই পথপদর্শন করেছেন। এখন আমি যদি ভুল করি বা ভুল পথে যাই আমাকে আমার হাতে ছেড়ে দিবেন না।
“ইয়া রব, হেদায়েত দেয়ার পর আপনি আমাকে আপনার দ্বীনের উপর অটুট রাখুন।”
“হে আমার রব, আমাকে উপকারী ইলম অর্জন করার তাওফিক দান করুন আর তার উপর আমল করার তাওফিক দান করুন। ”
তারপর একটা ঘটনা-
একজন পরিচিত ভাই এর হঠাৎ মৃত্যুতে অন্তরটা কেঁপে উঠল। চিন্তা করতে লাগলাম, নিজের মৃত্যুও তাে খুব কাছেই তাহলে দুনিয়া নিয়ে কেন পড়ে আছি। দ্বীনের পথে চলতে আমার তাে সঠিক কোনও জ্ঞানই নেই। অন্যকে কিভাবে দ্বীনের দাওয়াত দিবাে! আল্লাহর সামনে কি নিয়ে দাড়াবাে!
আমার রব যদি জিজ্ঞেস করেন সুযােগ থাকার পরেও কেন আল্লাহর রাস্তায় ইলম অর্জন করি নি? কি বলবাে সেদিন! এই ঘটনাটাই আমাকে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করার তাগিদ দিতে লাগলাে। এইসব চিন্তা করতে করতে মনকে শক্ত করে আল্লাহর রাস্তায় ইলম অর্জন করতে নেমে পড়ি। অবশেষে জুন মাসে অনলাইনে আলিম কোর্সে ভর্তি হই।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাকে ও আমার মতাে বাকি ইলম পিপাসু ভাই-বােনদের সাহায্য করুন। উপকারী ইলম অর্জন করার তাওফিক দান করুন ও সেই অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর রাস্তায় খেদমত করার জন্য আমাদের কবুল করুন।
আমিন।
আরো পড়ুনঃ
যেমন মেয়ে বিয়ে করতে বলেছেন রাসূল সাঃ