২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শুরুতে এক রকমের ফুরফুরে মেজাজে ছিল ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটসঙ্গী স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি। তবে সেই পরিস্থিতি বদলাতে সময় লাগেনি। আর বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গঠিত রাজনৈতিক দলটি এখন রাজনীতিতে একঘরে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর ধারাবাহিকতায় ৩১ আগস্ট বৈঠকের ডাক পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। তবে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতারা। মূলত তাদের বিরোধিতার মুখে পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারের আর কোনো বৈঠকে ডাক পায়নি জাতীয় পার্টি।
এই দলের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরে মুখোমুখি অবস্থানেও দেখা গেছে জাতীয় পার্টি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে রংপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন সেখানকার জাতীয় পার্টির নেতারা।
গত নভেম্বর মাসে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে কয়েকটি কার্যালয়ে আগুন ও ভাঙচুর করা হয়। তারপর থেকে দলটির কার্যক্রম বিবৃতিনির্ভর এবং চার দেওয়ালে বন্দী হয়ে আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত ১৫ বছর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দুঃশাসনের সঙ্গী ছিল এই জাতীয় পার্টি। ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের জন্য আওয়ামী লীগের মতো সমান দায়ী জাতীয় পার্টি। তাদের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত রাষ্ট্রের। জনগণ ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টিকে প্রত্যাখান করেছে। এখন সরকারের উচিত ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টির দায়কে আদালতের মাধ্যমে চিহ্নিত করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ যতটুকু দায়ী, তার চাইতে কম দায়ী নয় জাতীয় পার্টি। কারণ গত তিনটি নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হয়েছে, তা জাতীয় পার্টিও জানে। এর জন্য তারা সরকারের কোনো বিরোধিতা তো করেইনি, বরং তাদের সহযোগিতা করে গেছে।
বিগত তিনটি নির্বাচনে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করেছিল, সেই সরকারের অংশ ছিল জাতীয় পার্টি— এমন অভিযোগ করে এই বিশ্লেষক আরও বলেন, সেই সরকারের দুর্নীতিরও অংশ ছিল তারা। তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করেছে। তাই আমি মনে করি, গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের জন্য আওয়ামী লীগের মতো সমান দায়ী জাতীয় পার্টি। তাদের এই জায়গা থেকে মুক্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
জাতীয় পার্টির বিষয়ে আইনি ও বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
৫ আগস্টের পর জাতীয় পার্টির রাজনীতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দলটির কার্যক্রম এখন অনেকটা বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে চার দেয়ালে বন্দী হয়ে আছে। সেখানে থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে গণমাধ্যমে বক্তব্য-বিবৃতি পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে দলের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। এর মধ্য গত ১ নভেম্বর দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েও পালন করতে পারেনি জাতীয় পার্টি।
এই কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়ার পর জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী স্বৈরাচারের দোসর আখ্যা দিয়ে তাদের কার্যালয়ে ভাঙচুর এবং আগুন দেওয়া হয় ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ব্যানারে। ওই সময় সারা দেশে দলটির আরও কয়েকটি কার্যালয়ে ভাঙচুর এবং আগুন দেওয়া হয়।
যদিও এরইমধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত কয়েকটি দূতাবাসের হাইকমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
জাতীয় পার্টি গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের দাসত্বের ভূমিকা পালন করেছে। ফলে দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। তবে, দাবির বিষয়টি যৌক্তিক মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ দলের শীর্ষ নেতাদের অভিযোগ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল স্বাধীনভাবে কর্মসূচি পালন করার সুযোগ পেলেও তাদের কোনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এই অবস্থা বহাল থাকলে আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ করা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তবে, তাদের আশা নির্বাচনের আগে অবস্থার পরিবর্তন হবে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, বৈষম্য শুধু আমাদের সঙ্গে হচ্ছে না, সারা দেশের মানুষ আবার বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এই অবস্থা বলবৎ থাকলে একপেশে রাজনীতি হয়ে যাবে। দেশে একপেশে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেই নির্বাচনে আমরা যাবো কি না তখন সিদ্ধান্ত নেবো।
জি এম কাদের আরও বলেন “রাজনীতি করার অধিকার আমরা আদায় করে নেবো। কেউ আমাদের রাজনীতি করার অধিকার দেবে, সেই আশায় বসে থাকবো না” বলেও যোগ করেন তিনি।
জাপা মহাসচিব চুন্নু বলেন “সংগঠন করতে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি, অন্যদিকে সরকার আমাদের কোনো মিটিং কিংবা বৈঠকে ডাকছে না। তারা বলছে আমরা ফ্যাসিবাদের সহযোগী। সহযোগী হলে তার বিচার হবে, কিন্তু আমাদের তো রাজনীতি করার অধিকার আছে।”