মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মানবজাতির প্রয়োজন পূরণের যাবতীয় ব্যবস্থাও করেছেন। মানুষ ছাড়াও পৃথিবীতে বহু সৃষ্ট জীব আছে। পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে এগুলো মানবজাতির কল্যাণে নিয়োজিত।
মানুষের মতো তাদেরও রয়েছে ভূপৃষ্ঠে অবাধ বিচরণ। তারাও আল্লাহ তাআলার বিশাল সৃষ্ট পরিবারের সদস্য। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রাণী সম্পর্কে বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল প্রত্যেকটি জীব এবং (বায়ুমণ্ডলে) নিজ ডানার সাহায্যে উড়ন্ত প্রত্যেক পাখি তোমাদের মতোই একেকটি জাতি…।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৩৮)
ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল ছোট্ট একটি প্রাণী মোৗমাছি, গায়ে কালো-সোনালি দাগ, সারাদিন ফুল থেকে ফুলে উড়ে বেড়ায়, কিন্তু তার কর্মযজ্ঞের ব্যাপ্তি বিশাল। মৌমাছি—মহান আল্লাহর সৃষ্ট এক অপূর্ব নিদর্শন। এত ক্ষুদ্র অথচ এত বুদ্ধিমান! তার মস্তিষ্কের আকার তিলের মতো ছোট হলেও, সে মানুষের মতোই মুখ মনে রাখতে পারে, চিনতে পারে তার সঙ্গীদের। মৌমাছির ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে লুকিয়ে আছে গণিত, নেভিগেশন আর দলবদ্ধ বুদ্ধিমত্তার অবিশ্বাস্য প্রতিভা।
প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২০০ বার পাখা ঝাপটানো এই ছোট্ট প্রাণীটি ঘণ্টায় ৩০-৩৫ মাইল বেগে উড়ে ফুলের মধু সংগ্রহ করে। বিশেষ কোনো বাগানে ভালো মধুর সন্ধান পেলে তারা নাচের মাধ্যমে নিজেদের দলকে সংকেত দেয়, যা প্রকৃতির এক অপূর্ব রহস্য।
মৌমাছি এমনই বিস্ময়কর যে, পবিত্র কুরআনে এ প্রাণীর নামেই একটি সূরা রয়েছে। সুরাটি হচ্ছে
সুরা নাহল। ‘নাহল’ শব্দের অর্থ মৌমাছি। এই সূরায় মহান আল্লাহ মৌমাছির জীবনব্যবস্থা ও তাদের বিশেষ গুণাবলির কথা উল্লেখ করেছেন, যা মানুষের জন্য শিক্ষণীয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন—
“তোমার রব মৌমাছির অন্তরে প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছেন যে, তোমরা গৃহনির্মাণ করো পাহাড়, বৃক্ষ এবং মানুষ যে গৃহনির্মাণ করে তাতে।” (সুরা নাহল: ৬৮)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে—
“অতঃপর তোমরা প্রত্যেক ফল থেকে কিছু কিছু আহার করো এবং তোমার রবের সহজ পথ অনুসরণ করো। ওদের উদর হতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয় (মধু), যাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিষেধক। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।” (সুরা নাহল: ৬৯)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা মৌমাছিকে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা গৃহনির্মাণ করে নির্দিষ্ট স্থানে—পাহাড়ের কোণে, গাছের ডালে ও মানুষের ঘরের উচ্চস্থানে। বাস্তবেও আমরা দেখি, মৌমাছিরা এসব স্থান ছাড়া অন্য কোথাও বাসা বাঁধে না। তারা আল্লাহর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।
অন্যদিকে, মৌমাছিদের জীবনধারা মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। কুরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহ সহজ পথ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন।” মৌমাছিরাও ঠিক তেমনই তারা বারবার বিভিন্ন পথ পরিদর্শন করে দেখে কোন পথ সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর। সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করে তারা অধিক পরিমাণে মধু সংগ্রহ করে, যা মানুষের জন্যও শিক্ষা। কারণ মানুষ চাইলেই অল্প সময়ে বেশি কাজ করে সঠিক পথে চলতে পারে।
কী আশ্চর্য! একটি ছোট্ট পতঙ্গের ভেতরেও আল্লাহতালা এমন এক ক্ষমতা দিয়েছেন, যা মানুষের কল্যাণে আসে।
কারণ মৌমাছির জীবনযাত্রা অবিশ্বাস্যরকম শৃঙ্খলাবদ্ধ। তারা এমন এক জাতি, যারা নিজেদের মধ্যে সুস্পষ্ট দায়িত্ব বণ্টন করে নেয়। একটি মৌচাক মানেই একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্র। সেখানে রয়েছে রানী, রয়েছে কর্মী মৌমাছি, রয়েছে নিরাপত্তারক্ষী এবং মধু সংগ্রহকারী।
রানী মৌমাছি মৌচাকের প্রধান। তার নির্দেশেই চলে পুরো রাজ্য। সে তার জীবদ্দশায় লাখ লাখ ডিম দেয়, যাতে নতুন কর্মী মৌমাছি জন্ম নেয়। কিছু মৌমাছি সারাদিন শুধু নবজাতকদের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে, আবার কিছু মৌমাছি নিখুঁত ছয়-কোণবিশিষ্ট ঘর তৈরি করে, যা প্রকৃতির এক বিস্ময়। আর যারা মধু সংগ্রহের দায়িত্বে থাকে, তারা প্রতিদিন শত শত ফুলের পরাগ সংগ্রহ করে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঘরে ফেরে, তবু পথ হারায় না।
মৌমাছি যখন ফুলের মধু সংগ্রহ করে, তখন সে কেবল নিজের খাদ্যের চিন্তাই করে না। বরং সে এমন এক বস্তু মধু তৈরি করে, যা মানুষের জন্য অসীম উপকারী। আল্লাহতালা তাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, সে ফুলের মধু নেয়, কিন্তু ফুলের কোনো ক্ষতি করে না।
এখান থেকে মানুষ শিক্ষা নিতে পারে—নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্যের উপকার করা, নিঃস্বার্থভাবে সমাজের কল্যাণে কাজ করা।
তাছাড়া যদি কোনো মৌমাছি নোংরা বা দূষিত স্থানে বসে, তারপর সে মৌচাকে ফিরে আসে, তবে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মৌমাছিরা তাকে আর মৌচাকে প্রবেশ করতে দেয় না। এমনকি রানির আদেশে তাকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়, যাতে পুরো মৌচাক দূষিত না হয়ে যায়। তাদের এই কঠোরতা আসলে মৌচাককে নিরাপদ ও সুস্থ রাখার জন্যই।
আমাদের সমাজকেও ঠিক এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। যারা অন্যায় ও অপরাধে লিপ্ত হয়, তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সমাজ বিশৃঙ্খলার শিকার না হয়। আইন থাকার পরও যদি তার যথাযথ প্রয়োগ না হয়, তবে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়বে, সমাজ ধীরে ধীরে অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।তাই মানুষের উচিত মৌমাছির জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া।
কেননা আল্লাহর সৃষ্টি এই ছোট্ট প্রাণীটি আমাদের জন্য এক মহা শিক্ষা। যদি মানুষ মৌমাছির জীবন থেকে শিক্ষা নেয়, তবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র শৃঙ্খলাবদ্ধ, সফল ও উন্নত হতে বাধ্য।