অন্য ৮-১০ জনের মতোই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। যদিও অসারণ কর্মযজ্ঞে অনন্য ছিলেন অন্যদের চেয়ে। যার প্রতিটি নিশ্বাষের অক্সিজেন ছিল স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।
৬০-৭০ দশক কিংবা এখনও যুক্তরাজ্যের Royal College of Surgeons এ পড়া স্বপ্নের মতো চিকিৎসকদের কাছে। সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরর। ৬০ এর দশকে চিকিৎসক জাফরুল্লাহ যখন লন্ডনে Royal College of Surgeon এ আধুনিক চিকিৎসায় দিক্ষীত হচ্ছেন এদিকে দেশ তখন উত্তাল, জাতীর রন্দ্রে ঢুকেছে মুক্তির বীজ।
দেশের মুক্তির জন্য দূর থেকে কী ভীষন তাড়িত ছিলেন তা বুঝা যায় যখন জনসম্মুখে তৎকালিন পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলেন, আকুল ক্রদ্ধ তরুণ চিকিৎসক, সংগঠক, দেশে ফিরে আসেন, যোগ দেন রনাঙ্গনের সম্মুখ সমরে।
গেরিলা যোদ্ধা থেকে হয়ে ওঠেন রনাঙ্গনের চিকিৎসক। সাথে ছিলেন বন্ধু ডা. এম এ মোবিন। ত্রিপুরার মেরাঘরে গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রায় ৫০০ সয্যার হাসপাতাল।নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। ছন-বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা সেই হাসপাতালে ছিল, অপারেশন থিয়েটার। যুদ্ধে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশনও করা হতো বাঁশের তৈরি সেই হাসপাতালে। প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একদল সেবাদানকারী। স্বাধীন বাংলাদেশে প্যারামেডিকের ধারনা শুরু হয়েছিল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরির হাত ধরেই।
শুধু তাই নয় দুঃসসহ সেময় বিদেশী বন্ধুদেরকে চিঠি লিখতেন, মুক্তিকামী বাঙালিদের জন্য সাহায্য চাইতেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ পরবর্তিতে ১৯৭২ সালে সাভারের মির্জা নগরে মাত্র ৬টি তাবু দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু শুধু নামই ঠিক করে দেননি বরং দৃড়কন্ঠে বলেছিলেন “এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা হবে না। দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবকিছু নিয়ে কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে”।
সাভারের মির্জানগরে সরকারের ২৩ একর জমি দান করেন বঙ্গবন্ধু আর ৫ একর জমি দেন ডা. জাফরুল্লাহর বন্ধু ডা. মাহমুদুর রহমানের মা জোহরা বেগম।
অনন্য সাধারণ এই মানুষটি নিজ হাতে রোগীদের সেবা করতে পছন্দ করতেন।
স্বাধীনতার পর থেকেই দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং উন্নত যেকোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় ১০০ শয্যার একটি সর্বাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে তুলেছেন ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রণীত ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষধ নীতির অন্যতম রুপকার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরি। যার ফলে শক্ত ভীত পায় ঔষধ কোম্পানীগুলো, কমে ঔষধের দাম। অবশ্য এজন্য অনেক খেসারতও দিতে হয়েছে এই গুণী মানুষটিকে। তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বা বিএমএ থেকে। এই বিষয়ে তার লেখা The Politics of Essential Drugs বইটি সাড়া ফেলে বিশ্ব মহলে।
সহজ ভাষায় সাধারন মানুষকে স্বাস্থ বিষয়ক বার্তা দিতে ১৯৮০ সাল থেকে প্রকাশ হচ্ছে মাসিক গণস্বাস্থ্য।
এখন নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক কথা হয়। প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী-ই সর্বপ্রথম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করেছিলেন। যে কাজ নারী ‘পারে না’ বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত, সেসব কাজে তিনি নারীদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। ইলেকট্রিশিয়ান, কারপেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ড্রাইভার হিসেবে নারীদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রথম সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সাল থেকে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সদ্য প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সবসময় চেষ্টা করেছেন দেশের ভালোর জন্য কিছু করার। চেষ্টা করেছেন নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার। তিনি পুরোটা সময় দেশ ও মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। নিজের ক্যারিয়ারের চেয়ে দেশপ্রেমকে প্রাধান্য দিয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া এই মহান মানুষটি।
অসম্ভব পরিশ্রমী, সৎ, নির্লোভ, নির্ভিক ৮১ বছরের চির তরুণ, বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের পুরোধা ‘গরীবের ডাক্তার’ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাদাসিদে জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে একটা শার্ট-প্যান্ট পরেছেন। আর পায়ে দিতেন ২০০ টাকার প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘দেশের মানুষ পেট ভরে খেতে পায় না, সবাই জামা-কাপড় পরতে পারে না। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ করেছি মানুষের খাওয়া-পরার সমস্যা না থাকার জন্য। এখানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তাই আমাকে বিলাসিতা মানায় না।’
কোটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত ডা জাফরুল্লাহ যাপন করে গেলেন সার্থক ও পরিপূর্ণ এক জীবন। অনুকরণীয়, অনুসরণীয় মানুষটির জীবনের কাহিনি মিথকেও হার মানায়।
সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ধারায় বিশ্বাসি এই মানুষটি দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষের পাশে থাকা যায়। কঠিন পরিস্থিতেও কীভাবে সাবলিল থাকা যায়। যখন যেখানে মানুষ ভয় পেয়েছে, নিঃশ হয়েছে, কেঁদেছে সেখানে ছুটে গেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরি। সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সবসময়। ২০১১ সালে র্যবের গুলিতে পা হারানো লিমন যখন ভয়াবহ বিপদে নিমজ্জিত তখন তার পাশে বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরি। সেই লিমন এখন গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক।
কারাবন্দী আলেমদের মুক্তি দিতে ও বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে ঈদের দিন বাসায় গিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানাতেও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহব্বান জানিয়ে গেছেন মুক্তিকামী ও জনদরদী ডা জাফরুল্লাহ।
জীবনের প্রতিটি নিশ্বাসে জণগণকে নিয়ে ভাবুক ডা জাফরুল্লাহ সাধারন মানুষের কথা চিন্তা করে করোনা চিকিৎসায় দামি ওষুধ গ্রহণ করতে রাজি হননি। তার কথা ছিল, ‘প্রথমত করোনা চিকিৎসায় এত দামি ওষুধ দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, যে ওষুধ কেনার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের নেই, সেই ওষুধ আমি খাব না।’ কোনো ডাক্তার তার মত পরিবর্তন করাতে পারেননি।
জীবনের অন্তীম মুহুর্তে এসেও বিদেশে চিকিৎসা গ্রহনে রাজি হননি আপাদমস্তক দেশপ্রেমীক এই মানুষটি।
উনিশশো একচল্লিশ সালের ২৭শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে জন্মগ্রহণ করা ক্ষণজন্মা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের নায়ক, আইকন। সারাটা জীবন কাটিয়ে গেলেন কাউকে তোয়াক্কা না করে। জীবনকে ব্যয় করে গেলেন দেশের গরিব মানুষের জন্য। সৎ, নির্লোভ, নির্ভিক ৮১ বছরের চির তরুণ যাপন করে গেলেন সার্থক ও পরিপূর্ণ এক জীবন। অনুকরণীয়, অনুসরণীয় লড়াকু বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরি ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১৯ রমজান মঙ্গলবার রাত সোয়া এগারোটায় নিজের প্রতিষ্ঠিত ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
সমাজসেবার স্বীকৃতি হিসাবে জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন এই গুণী ব্যক্তি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখায় ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে ফিলিপাইন সরকারের র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, ১৯৯২ সালে সুইডেনের বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড পুরস্কার, ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ পুরস্কার এবং মানবতার সেবার জন্য ২০২১ সালে কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ২০২২ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার এবং পল্লীবন্ধু পুরস্কার পান। সবশেষ গত ১৮ মার্চ সমকাল ও চ্যানেল ২৪-এর ‘দেশের যোদ্ধা বন্ধু সবার’ গুণীজন সম্মাননা লাভ করেন।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অসম্ভব পরিশ্রমী, কিন্তু জীবনযাপন, কাজ ও কথায় অগোছালো একটি ব্যাপার দৃশ্যমানভাবেই বোঝা যেত। সারা জীবনই যা ভালো মনে করেছেন, তা করেছেন ও বলেছেন। কখনো এর পরিণতি চিন্তা করেননি।
দুয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে কিছুটা হয়তো বোঝা যাবে—
১. জিয়াউর রহমান মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে ডা. জাফরুল্লাহকে বলেছিলেন, ‘আপনি আপনার মতো করে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন, যা করতে চান। আপনাকে ব্ল্যাংক চেক দেবো।’
উত্তরে ডা. জাফরুল্লাহ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘তা হয় না। যারা ব্ল্যাংক চেক দেয়, তাদের ব্যাংকে টাকা নেই।’
২. আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন চলছিল। তৎকালীন গভর্নর আযম খান ঢাকা মেডিকেলে আসলেন শিক্ষার্থীদের এটা বোঝাতে যে কেন তাদের আন্দোলন করা উচিত নয়। গভর্নরের পথ আটকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। হাত ধরে বললেন, ‘আপনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দিতে বলছেন। আর আমাদের ছাত্র সংসদের ভিপি আহমদ জামান ও জিএস বদরুদ্দোজা ওয়ারেন্ট নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তা কি আপনি জানেন?’
গভর্নরের হাত ছাড়লেন না কয়েক মিনিট। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে পালাতে বললেন। তিনি পালাননি। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন।
৩. মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় শিক্ষকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণসহ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন তিনি।
৪. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত ধূমপান করা যাবে না। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং তার চাকরির মেয়াদ শেষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরির মেয়াদ বাড়ালেন না। ড. ওয়াজেদ মিয়া দেখা করলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে চান। সমস্যা হলো ধূমপান। ড. ওয়াজেদ মিয়া প্রচুর ধূমপান করতেন। এক মাস সময় নিয়ে পরিপূর্ণভাবে ধূমপান ছেড়ে দিয়ে বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি যুক্ত হন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য। শারীরিকভাবে তিনি নেই। তবে তার গড়া প্রতিষ্ঠান আছে, থাকবে। জনগণের ভালোবাসায় অমর হয়ে থাকবেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। জনগণই তাদের প্রয়োজনে টিকিয়ে রাখবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।