বর্তমান বিশ্বের মুসলিমদের হেদায়েতের জন্য ইসলামের প্রথম খলীফা আবু বকর আস-সিদ্দীক রাযিয়াল্লাহু আনহুর জীবন ও কর্ম মহামূল্যবান একটি পাথেয়।

ইসলামের সর্বশেষ নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইনতেকালের পর সাহাবী রাযিয়াল্লাহু আনহুমদের পরামর্শের ভিত্তিতে মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন আবু বকর রাঃ।

নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যথার্থভাবেই যোগ্য নেতৃত্বের পরিচয় দেয়েছেন। আল্লাহ তা’আলার সাহায্যে তিনি জটিল সময়ে উম্মতকে পথ দেখেয়েছেন।

খলীফা হওয়ার পর তিনি আরবে অনেক চ্যালেন্জের মুখোমুখি হন; কিছু লোক মুরতাদ হয়ে যায়, কিছু লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করে, আবার কেউ কেউ মিথ্যা নবী দাবি করে অনুসারীও জোগাড় করে ফেলে।

আরবের বাইরে পারস্য ও রোম সম্রাটরা এসব পর্যবেক্ষণ করে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাম্রাজ্য ধ্বংসের পথ খুঁজতে থাকে।

আল্লাহর অশেষ রহমতে আবু বকর রাঃ এসব চ্যালেন্জ মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে অবিশ্বাস্য সফলতা লাভ করেন। তিনি কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে দিকে দিকে ইসলামের বিজয়ের সূচনা করেন এবং অত্যাচারি শাসকদের পরাজিত করে গোটা পৃথিবীতে ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত করার পথ উন্মোচন করেন। সঙ্গতকারনেই তাঁর নেতৃত্ব ও শাসন আজকের আধুনিক মুসলিমদের প্রেরণার এক বিরাট উৎস।

রাসূল সাঃ এর ইনতেকালের পর বনু সাঈদা গোত্রের চত্বরে সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুমদের এক গণজমায়েতে আবু বকর রাঃ খলীফা হিসেবে নির্বাচিত হন এবং উপস্থিত সকলেই তাতে সম্মতি জানিয়ে তার হাতে বায়াত হন। তাঁদের মধ্যে উমর রাঃ সর্বপ্রথম বায়াত হন।

রাসূলের (সাঃ) ইনতেকালের পরদিন মসজিদে নববীর মিম্বরে বসেছিলেন এবং তখন সর্বসাধরন জনগণ সাবাই তাঁর হাতে বায়াত হন। তারপর আবু বকর রাঃ সাধারন জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন যা মুসলিম জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরনীয় এবং উৎসাহব্যঞ্জক ভাষণ হিসেবে প্রসিদ্ধ। তাঁর এই ভাষণে শুধুমাত্র মুসলিম নয় বরং আধুনিক পৃথিবীর সকল শাসকদের জন্যই রয়েছে মূল্যবান শিক্ষা ও নীতিনির্ধারকদের জন্য অনুকরণীয় পাথেয়। নিচে তাঁর মহামূল্যবান ভাষনের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো।

ইসলামের প্রথম খলীফা আবু বকর রাঃ এর ভাষণঃ

ভাষণের শুরুতেই তিনি মহান প্রভুর প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করেন, এরপর বলেনঃ-

হে লোকসকল, আমি আপনাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, অথচ আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই।

যদি আমি ভালো কাজ করি, তবে আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন এবং যদি আমি অন্যায় কাজ করি, তবে আপনারা আমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবেন।

স্মরণ রাখবেন, সততা আমানত আর মিথ্যা খেয়ানত। ইনশাআল্লাহ, আপনাদের মধ্যে দুর্বল ব্যক্তি আমার নিকট শক্তিশালী যতক্ষণ না আমি তার অধিকার আদায় করে দিতে পারি। আর আপনাদের মধ্যে শক্তিমান ব্যক্তি আমার নিকট দুর্বল, যতক্ষণ না তার থেকে হকদারের অধিকার ফিরিয়ে এনে দিতে পারি।

যে জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ করা পরিত্যাগ করে, আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত-অপমানিত করেন। যে জাতির মধ্যে অশ্লীলতা ব্যাপক হয় সে জাতির উপর আল্লাহ ব্যাপকভাবে বালা-মুসিবত নাযিল করেন।

আমি যতক্ষণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করি ততক্ষন আপনারা আমার আনুগত্য করবেন। আর যদি আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্য হই তাহলে আমার আনুগত্য করতে আপনারা বাধ্য নন। আচ্ছা, এখন সবাই নামাজের জন্য উঠে দাঁড়ান। আল্লাহ আপনাদের প্রতি সদয় হোন। সূত্রঃ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬/৩০৫, ৩০৬

সংক্ষেপে বলা যায়, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নীতিনির্ধারণী ভার্সনটি চিরকাল বিশ্বের সকল রাষ্ট্রনায়কদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তার এই ভাষণটি লিখতে গেলে এক অনুচ্ছেদও হবে না, অথচ এর মধ্যে তিনি তার শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি বর্ণনা করে দিয়েছেন।

তিনি শাসক এবং দেশের নাগরিকদের মধ্যে ন্যায় বিচার এবং পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি এটাও অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে উল্লেখ করেছেন যে, শাসকের প্রতি জনগণের আস্থা ততক্ষণ থাকে যতক্ষণ শাসক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অনুগত থাকে।

ভাষণে তিনি আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন; একটি হচ্ছে, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং আরেকটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, সামাজিক ব্যবহার।

তিনি সর্ব সাধারন জনগনের সামনে এটা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন যে, তারা যদি বহিরাগত আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকতে চায়, তাহলে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেখানো পদ্ধতিতে জিহাদ করতে হবে। আর দেশের আভ্যন্তরীন বিষয়ে লোকদেরকে অন্যায় এবং সকল প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেশের জন্য ব্যাপক বিপর্যয় ডেকে আনে যা একটি জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।

মূলত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রণীত আইন সমূহ এর উৎস ছিল পবিত্র কুরআন মাজীদ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। আল্লাহ বলেন,

انا انزلنا اليك الكتاب بالحق لتحكم بين الناس بما اراك الله ، ولا تكن للخائنين خصيما

নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যার প্রতি আল্লাহ আপনাকে দিক নির্দেশ করেন। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না। তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

‘আল্লাহর নাফরমানীর কাজে কোন রুপ আনুগত্য নেই আনুগত্য করতে হয় কেবলমাত্র নিয়ে সঙ্গত কাজে’

ব্যক্তিজীবন ও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি কুরআন ও সুন্নাহর উপর অটল ছিলেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে ব্যক্তিজীবন ও আমাদের পরিবারে সর্বোপরি আল্লাহর জমিনে সকল রাষ্ট্রে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে একটি কল্যাণকর জাতি গঠনের তাওফিক দান করুন, আমিন।

আরো পড়ুনঃ

আবু বকর রাঃ কেন উমর রাঃ এর দাড়ি ধরে ধমক দিয়েছিলেন?

Share.

Leave A Reply