ইসলামের প্রথম খলীফা আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং দ্বিতীয় খলীফা ওমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু সর্বদাই রাসূল সাঃ নির্দেশ ও সুন্নতের উপর ছিলেন অবিচল। তবে দু’জনের মধ্যে আবু বকর রাঃ ছিলেন অগ্রগামী। রাসূল সাঃ এর ইন্তেকালের পর ওমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ খলীফা আবু বকর রাঃ এর নিকট একটি দাবি উত্থাপন করলে আবু বকর রাঃ প্রচন্ড রেগে যান এবং ওমর রাঃ এর দাড়ি ধরে ধমক দেন। আজকের লেখায় আমরা পুরো ঘটনাটি বিস্তারিত আলোচনা করবো। পুরো লেখাটি পড়ে অন্যদেরকে জানানোর জন্য লেখাটি শেয়ার করবেন ইনশাল্লাহ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় আরব উপত্যকায় দু-টি পরাশক্তি ছিল। রোমান সাম্রাজ্য এবং পার্শিয়ান সাম্রাজ্য। উপত্যাকার উত্তরাংশে বিরাট এলাকা জুড়ে রোমানদের রাজত্ব ছিল। এসব এলাকার শাসকরা রোম রাজার প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করত।

তৎকালীন পরাশক্তি রোমানরা আরবদেরকে খুব নিচু দৃষ্টিতে দেখতো। তারা যখন দেখল যে আরবরা সবাই ধর্মের ছায়া তলে একতাবদ্ধ হচ্ছে তখন তারা ভীষণ ক্ষেপে গেল। এজন্য তারা দক্ষিণ আরব উপত্যকায় আকম্কি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল।

ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিহয়াহ কলবি রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। ব্যক্তিগত আক্রোশের কারনে হিরাক্লিয়াস সত্য থেকে বিমুখ থাকে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পড়েন।

বস্তুত তৎকালীন পরাশক্তি রোমানদেরকে সবাই ভয় করত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের অন্তরে দৃঢ়তা তৈরি করা এবং আক্রমণাত্মক কৌশল অবলম্বন করে একচ্ছত্র রাজত্বের ব্যাপারে রোমানদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সমরকৌশল নির্ধারণ করলেন।

এই কৌশলের অংশ হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরব উপত্যকার উত্তরে রোমানদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি এলাকায় মুসলিম বাহিনী প্রেরণ করেন। ফলে রোম সম্রাট নিয়ন্ত্রিত আরব অধ্যুষিত ওই এলাকায় মুসলিম বাহিনীর সাথে রোমান এবং আরব খ্রিস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধ হয় ইতিহাসে যা মূতার যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ।

অষ্টম হিজরীতে সংঘটিত এ যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়োগকৃত তিনজন সেনাপতিই শহীদ হয়ে যান। তারা হলেন, যায়েদ ইবনে হারেসা, জাফর ইবনে আবু তালিব, এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাযিয়াল্লাহু আনহুম। যখন শেষ সেনাপতিও শহীদ হয়ে যান, তখন বিখ্যাত সাহাবী খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধের ভার গ্রহণ করেন।

তিনি আল্লাহর সাহায্যে রোমানদের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রায় সকল মুসলিম মুজাহিদকে অক্ষত অবস্থায় প্রচুর গনিমতের সম্পদসহ মদিনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

নবম হিজরীতে রাসুল সাঃ মুসলমানদের এক বিরাট বাহিনীকে সিরিয়া এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহে প্রেরণ করেন। মুসলিমদের বিশাল বাহিনী দেখে ওই এলাকার শাসকরা ইসলামের শাসন মেনে নেন এবং শান্তি চুক্তি করে জিজিয়া বা কর দিতে রাজি হন।

ফলশ্রুতিতে রোমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এবং মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে। ফলে ভবিষ্যতে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে মুসলিম বাহিনীর সকল সদস্যের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়।

পরিশেষে ১১ হিজরীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে জানান যে, তিনি মুসলিম বাহিনীকে তৎকালীন পরাশক্তি রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বালকা এবং প্যালেস্টাইনে প্রেরণ করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঘোষণা শুনে মুহাজির এবং আনসার সাহাবীদের মধ্যে অনেক প্রসিদ্ধ সাহাবীরাও অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে অবাক করে দিয়ে এই বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করেন কম বয়সী যুবক ওসামা ইবনে যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহুকে।

এই মুসলিম বাহিনীতে অনেক প্রসিদ্ধ সাহাবীর মধ্যে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এজন্য সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলল, কেন ওসামাকে সেনাপতি নিয়োগ করা হলো? কেন একজন বয়স্ক সাহাবীকে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করা হলো না? তারা এটা বুঝতে পারেনি যে, রাসূল সাঃ সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর এই বিষয়ে আর প্রশ্ন করার অবকাশ ছিল না।

সাহাবায়ে কেরামের মনোভাব বুঝতে পেরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওসামার নেতৃত্বের প্রতি তোমরা সমালোচনা করছ। তার পিতার নেতৃত্বের প্রতিও তোমরা সমালোচনা করেছ। আল্লাহর কসম, নিশ্চয়ই সে নেতৃত্তের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি ছিল এবং আমার সবচেয়ে প্রিয় পাত্রদের একজন ছিল। অতঃপর তাঁর পুত্র আমার সবচেয়ে প্রিয় পাত্রদের একজন।

ওসামা রাযিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী অভিযানের উদ্দেশ্যে মদিনা ত্যাগ করার দুদিন পরেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন মুসলিম বাহিনী আশ-শামের দিকে যাত্রার পরিবর্তে মদীনা থেকে তিন মাইল উত্তরে জুরফ এলাকায় ক্যাম্পিং করল।

পরদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের খবর শুনে ওসামা বাহিনী সঙ্গত কারণেই মদিনায় ফিরে এলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের পর আরবে মুরতাদদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে গেল এবং চতুর্দিকে এত বেশি ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা বেড়ে গেল যে মদিনায় যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়ে গেল।

ফলে মুসলমানগন নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হলো যে, এ অবস্থায় ওসামার বাহিনীকে পাঠানো ঠিক হবে নাকি মদিনায় রেখে দেওয়া উত্তম হবে? কিন্তু ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় নেওয়া সিদ্ধান্তের উপর অটল ছিলেন অর্থাৎ তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে বাহিনীকে প্রেরণের সিদ্ধান্তে দৃঢ় ছিলেন। এবং তিনি এক ব্যক্তিকে ঘোষণা করতে বললেন যে, ওসামার বাহিনীকে তার মিশন সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে অভিযানে বের হতে বলো। আর যারা প্রথমবার ওসামার বাহিনীতে যোগদান করেছিল, তাদের মধ্যে কেউই যেন মদিনায় না থাকে, সকলেই যেন জুরফে গিয়ে ওসামার বাহিনীর সাথে মিলিত হয়।

কিছু সাহাবী আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে এই বলে পরামর্শ দিলো যে, তিনি যেন ওসামার বাহিনীকে অভিযানে না পাঠিয়ে যেকোন বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য ওসামার বাহিনীকে মদিনার কাছাকাছি প্রস্তুত রাখেন। ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় ওসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বাহিনীর সকল সদস্যকে নিয়ে মদিনায় ফিরে আসার জন্য খলীফার নিকট অনুমতি চেয়ে পত্র দিয়ে ওমর ইবনে খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহুকে মদিনায় প্রেরণ করেন।

খলিফা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এই বিষয়ে মুসলমানদের সাথে আলোচনার জন্য বৈঠক আহ্বান করেন এবং সকলের বক্তব্য মন দিয়ে শোনেন কিন্তু তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেওয়া সিদ্ধান্ত কিছুতেই স্থগিত করতে রাজি হলেন না।

সকল সাহাবীর মতামত শোনার পর তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, এবং সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, আল্লাহর শপথ! হিংস্র জন্তুসমূহ যদি আমার দেহের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় তবুও আমি ওসামার বাহিনীর সিরিয়া অভিযান বন্ধ করব না। আর যদি এ শহরে আমি ছাড়া একজন লোকও না থাকে তবুও আমি এই বাহিনী প্রেরণ করবোই।

উপস্থিত সকলেই আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও তারা কম বয়সি ওসামা রাযিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্তের ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করেন। সাহাবীরা ওসামার পরিবর্তে অধিক বয়স্ক ও অভিজ্ঞ কাউকে সেনাপতি নিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন।

এ বিষয়টি খলীফার নিকট উত্থাপনের জন্য আনসার সাহাবীদের একটি দল ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট প্রেরণ করেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু যিনি আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খুব বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ছিলেন তিনি খলিফাকে বললেন, ‘আনসারদের পক্ষ থেকে ওসামার পরিবর্তে একজন প্রবীণ ও বয়স্ক কাউকে সেনাপতি নিয়োগের দাবি আসছে।’

ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই কথা শেষ হতে না হতেই আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু যেখানে বসা ছিলেন সেখান থেকে লাফ দিয়ে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু দাড়ি ধরে বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহর রাসূল যাকে এই অভিযানের জন্য অধিনায়ক নিযুক্ত করেছেন, তাকে পদচ্যুত করার জন্য তুমি আমাকে পরামর্শ দিচ্ছ? ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু একথা শুনে সেখান থেকে ফিরে এলেন।

বাহিরে অপেক্ষমান আনসার সাহাবীরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করলেন? ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু ক্রোধান্বিত হয়ে জবাব দিলেন ‘যাও ভাগ। তোমাদের জন্য আমি খলিফার কাছে কীভাবেইনা লজ্জিত হলাম!’

অতঃপর আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু পায়ে হেঁটে ওসামা রাযিয়াল্লাহু আনহুর বাহিনীকে অভিযানের উদ্দেশ্য বিদায় জানালেন। এবং রাসূল রাযিয়াল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়োগকৃত মুসলিম সেনাপতি ওসামা রাযিয়াল্লাহু আনহুর অনুমতি নিয়ে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তিনি যুদ্ধ থেকে মদিনায় ফিরিয়ে আনেন তার শাসনকার্যে সহযোগিতা করার জন্য। কেননা ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিল আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর বিশ্বস্ত উপদেষ্টা।

এ অভিযানের ফলাফল ছিল খুবই সন্তোষজনক। ওসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং তার বাহিনী শত্রুদের পরাজিত করে অনেক গনিমতের মাল নিয়ে মদিনায় ফিরে আসে। যখন ওসামার বিজয়ী বাহিনী মদীনায় প্রবেশ করছিল তখন আবু বকর ও ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুম মুহাজির এবং আনসারদের অনেক বিখ্যাত সাহাবীদেরকে নিয়ে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে শহরের বাহিরে যান। তারা ছিল খুব উচ্ছাসিত ও উজ্জীবিত আর সবার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল “আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই”।

ওসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু মদীনায় প্রবেশ করেই মসজিদে নববীতে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করেন। আল্লাহ তা’আলা আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু, ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু, ওসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং সকল সাহাবীদের উপর রহম করুন, আমিন

Share.

Leave A Reply