দেওবন্দ মাদ্রাসার ইতিহাস ।। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ও বিখ্যাত ক্বওমি মাদ্রাসা ” দারুল উলুম দেওবন্দ ” ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে অবস্থিত। ১৮৬৬ সালে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও বুজুর্গানেদ্বীন এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। দেওবন্দ মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ইসলামি পুনর্জাগরণ প্রাথমিকভাবে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানে শুরু হলেও, পরবর্তীতে ইসলামের এই আন্দোলন সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সৌদি আরবেও দেওবন্দি ধারার মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

The Holy Media-র ইতিহাসের ডায়েরি থেকে আজ আলোচনা করব ইসলামি শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপিঠ দারুল উলুম দেওবন্দ সম্পর্কে ।

মুঘল শাষনামলে তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে হাজার হাজার ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল।  ১৯২২ খৃষ্টাব্দে মিশর থেকে প্রকাশিত সুবহুল আশা গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে শুধু রাজধানি দিল্লীতেই ১ হাজার মাদ্রাসা ছিল। প্রফেসর মার্কমিলসের বর্ণনা অনুসারে বৃটিশ বেনিয়াদের শাষন পূর্বে শুধু বাংলাদেশেই ৮০ হাজারের উপরে মাদ্রাসা ছিল।  কিন্তু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদিদের কূট কৌশলের কারনে প্রায় সকল মাদ্রাসা অচল হয়ে যায়। ২-৪টি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান স্ব উদ্যোগে টিকে থাকলেও ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর সেগুলোকেও বন্ধ করে দেয় বৃটিশ বেনিয়া দল। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায় । এ বিষয়টি তৎকালীন আলেম-উলামা ও বুজুর্গানেদ্বীনকে ভাবিয়ে তোলে।

দেওবন্দ ছিল হযরত কাশেম নানুতুবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর শশুরালয়। সেখানে গেলে তিনি সাত্তা মসজিদেই নামাজ আদায় করতেন। হাজী আবেদ হোসাইন রহিমাহুল্লাহ ছিলেন সাত্তা মসজিদের ইমাম। মাওলানা জুলফিকার আলীমাওলানা ফজলুর রহমান ছিলেন দেওবন্দের বাসিন্দা। এসব বুজুরগানে দ্বীন নামাজ শেষে হাজী আবেদ হুসাইনের কামরায় সমবেত হয়ে ইসলামের প্রচার প্রসার ও এলমে দ্বীন শিক্ষার বিষয়ে আলোচনা করতেন।

একদিন সাত্তা মসজিদের ইমাম হাজী আবেদ হুসাইন ফজরের নামাজান্তে ইশরাকের নামাজের অপেক্ষায় মসজিদে মোরাকাবারত ছিলেন। হঠাৎ তিনি ধ্যানমগ্নতা ছেড়ে নিজের কাঁদের রুমাল দিয়ে একটি থলে বানিয়ে তাতে নিজের পক্ষ থেকে তিন টাকা রাখলেন। অতঃপর তা নিয়ে তিনি মাওলানা মাহতাব আলীর কাছে গেলেন তিনিও উৎসাহে সেখানে ছয় টাকা দিলেন এবং তার এই উদ্যোগের জন্য দোয়া করলেন। এরপর মাওলানা ফজলুর রহমান দিলেন ১২ টাকা এবং হাজী ফজলুল হক দিলেন ৬ টাকা এবং বিশিষ্ট জ্ঞান অনুরাগী জুলফিকার আলী দিলেন ১২ টাকা ।

এভাবেই সেদিন সন্ধা পর্যন্ত তিনশত টাকা জমা হয়ে গেল। জনগণের উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে মাওলানা আবেদ হোসাইন মিরাটে কর্মরত হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি-র নিকট এই মর্মে পত্র পাঠালেন যে আমরা মাদ্রাসার কাজ শুরু করে দিয়েছি আপনি অনতিবিলম্বে চলে আসুন।

চিঠি পেয়ে হযরত নানুতুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মোল্লা মাহমুদকে শিক্ষক নিযুক্ত করে পাঠিয়ে দিলেন এবং তার মাধ্যমে মাদ্রাসার কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে চিঠি দিলেন। পৃথিবী বিখ্যাত এই মহাবিদ্যাপিঠের প্রথম ছাত্র ছিলেন মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী। যিনি পরবর্তীকালে শাইখুল হিন্দ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

এভাবেই সরকারি কোনরকম অনুদান ছাড়াই গণচাঁদার উপর ভিত্তি করে ইসলামী শিক্ষা ধারাকে সচল ও সজীব রাখা এবং ইসলামী তাহজিব ও তামাদ্দুনকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি মুসলীম জাতীর হারানো ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারের যে অভিনব ধারার সূচনা হয় তা জাতির ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে।

দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশকে ইংরেজদের কবল থেকে মুক্ত করা এবং ধর্মীয় শিক্ষাকে পুনরোজ্জীবিত করা। তৎকালীন প্রধান মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের জন্য সরকারি অর্থের চেয়ে গণচাঁদার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেন। সেথেকেই দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার ভাবধারায় পরিচালিত বিশ্বের আনাচে-কানাচে সকল মাদ্রাসা এই মূলনীতির উপর পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠালঘ্ন থেকেই দেওবন্দ মাদ্রাসা আটটি মূলনীতির উপর পরিচালিত হয়ে আসছে এগুলোকে উসুলে হাসতে গানা বলা হয়।

এই মূলনীতি গুলোর সারসংক্ষেপ হলো:

১. যথাসম্ভব মাদ্রাসার কর্মচারী ও কর্মকর্তাদেরকে অধিক হারে চাঁদা আদায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে; এবং মাদ্রাসার হিতাকাঙ্খীদেরও এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

২. যেভাবেই হোক মাদ্রাসার ছাত্রদের খানা চালু রাখতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে তা উন্নতি করতে হবে।

৩. মাদ্রাসার উপদেষ্টাগণ প্রতিষ্ঠানের উন্নতি অগ্রগতি এবং সুষ্ঠ ও সুশৃংখল ব্যবস্থাপনার স্বার্থে নিজের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যের মতামতকে সহনশীলভাবে গ্রহণ করতে হবে।

৪. মাদ্রাসার সকল মুরুব্বীদেরকে অবশ্যই সমান চিন্তা চেতনার অধিকারী হতে হবে। দুনিয়া লোভী আলেমদের মত নিজের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে না।

৫. মাদ্রাসার নির্ধারিত পাঠ্যসূচি অবশ্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে।

৬. মাদ্রাসার জন্য স্থায়ী আয়ের উৎস তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে হবে, কেননা স্থায়ী সম্পদ তৈরি হলে আল্লাহর গায়েবী সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে বিদ্বেষ ও কলহ বিবাদ ছড়িয়ে যাবে; মাদ্রাসার সকল প্রকার অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অনাড়ম্বরতা ও উপায় উপকরণহীন অবস্থা বহাল রাখার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

৭. সরকার ও আমির ওমরাদের সংশ্লিষ্টতাও এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

৮. এমন ব্যক্তিদের থেকে চাঁদা গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে যারা চাঁদা দানের মাধ্যমে সুখ্যাতি লাভের চেষ্টা করবে না। জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দেওবন্দ কখনও এক পয়সা সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সাহায্য নেয়নি – ফিরিয়ে দিয়েছে রাজা বাদশাহদের অনুদানও।

দারুল উলুম দেওবন্দ প্রবর্তিত সিলেবাসে ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুন, কুরআন হাদিস শিক্ষার পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থী যাতে প্রয়োজনীয় প্রার্থীব জ্ঞান অর্জন করে নিজ জীবনের নিত্যদিনের প্রয়োজন গুলো অনায়াসেই মেটাতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বর্তমানে এই মাদ্রাসায় রয়েছে বেসিক কম্পিউটার, গ্রাফিক্স ডিজাইনসহ বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের সুব্যবস্থ। আছে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। এছাড়াও শিক্ষ্যার্থীরা এখান থেকে আধুনিক ইউনানি  চিকিৎসার প্রশিক্ষণও গ্রহণ করতে পারে।

যুগ সম্মত এই শিক্ষাধারা সম্প্রসারণের ফলে মাত্র একশত বছরের স্বল্প সময়ে তা উপমহাদেশের আঁনাচে-কাঁনাচে এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। বর্তমানে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার শিক্ষা দ্বারায় পরিচালিত বাংলাদেশে পাঁচ হাজারেরও অধিক ক্বওমি মাদ্রাসা রয়েছে।

এছাড়াও গ্রামে গঞ্জে মসজিদে মসজিদে গড়ে ওঠা মক্তবের সংখ্যা ৬০ হাজারেরও অধিক।

বাংলাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা ভাসানী, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রয়াত আমির, প্রখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা শাহ আহমদ শফী, প্রয়াত মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, প্রয়াত আমীর আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী, এবং প্রখ্যাত ইসলামিক পন্ডিত শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহিমাহুল্লাহুমদের মত পন্ডিত ব্যক্তিবর্গও দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র ছিলেন।

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ছাড়াও কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, এবং সৌদি আরবের অনেক ইসলামী পণ্ডিত ব্যক্তিও দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র।

এই মাদ্রাসার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা মনে করেন যে, দারুল উলুম দেওবন্দে ইসলামী শরীয়ত ও আধ্যাত্মিকতার যে পাঠদান করা হয় তা বিশ্বের আর কোন প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যায় না।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও ইসলাম বিরোধী আইন, ও মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সোচ্চার ভূমিকা রেখে আসছে দারুল উলুম দেওবন্দ। ভারতের স্বাধীনতা ও রেশমী রুমাল আন্দোলনেও ব্যপক ভূমিকা রাখে বিখ্যাত এই বিদ্যাপিঠ। ভারত স্বাধীনতার মহান সেনানী এবং রেশমী রুমাল আন্দোলনের পুরোধা শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদ হাসান-ই সর্বপ্রথম মোহনদাস করোম চাঁদ গান্ধীকে মহাত্মা উপাধি প্রদান করেন । এই মাদ্রাসা ইসলামের নামে সকল প্রকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও সর্বদা সোচ্চার।
২০০৮ সালের ৩১ শে মে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার ব্যানারে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বিশ্বশান্তি সম্মেলন নামে দিল্লির রামলীলা ময়দানে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে লক্ষাধিক আলেমের উপস্থিতিতে সন্ত্রাসবাদের উপর ফতোয়া জারি করে দারুল উলুম দেওবন্দ।

সমাবেশে পঠিত ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মুফতি হাবিবুর রহমান খায়রাবাদী।

ফতোয়ায় বলা হয়,

ইসলাম সকল প্রকারের অন্যায্য সহিংসতা, শান্তির লঙ্ঘন, রক্তপাত, হত্যা ও লুণ্ঠনকে প্রত্যাখ্যান করে এবং এর কোনরূপ অনুমতি প্রদান করে না। এটিই ইসলামের মূলনীতি যে, আপনি সৎকর্মে পরস্পরকে সহায়তা করেন এবং পাপ বা নিপীড়নের জন্য কাউকে সহযোগিতা করবেন না। পবিত্র কুরআনে প্রদত্ত সুস্পষ্ট নির্দেশিকাতে এটা স্পষ্ট যে, বিশ্ব শান্তির নির্দেশ দেওয়া ইসলামের মতো ধর্মের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার সন্ত্রাসবাদ মুছে ফেলার জন্য এবং বিশ্ব শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল।

দেওবন্দের এই ফতোয়াকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি সহ ভারতের সমস্ত প্রধান রাজনৈতিক দল স্বাগত জানিয়েছে। বিজেপি এই ফতোয়াকে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেছে।

পৃথিবীর বুকে প্রাচীন যত বিশ্ববিদ্যালয় আছে তার মধ্যে মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। এটি শুধু মুসলীম বিশ্বে নয় বরং পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপিঠ।

The Holy Media-র পরবর্তী পর্বে জানাবো আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং কীভাবে বাংলাদেশ থেকে প্রাচীন এই বিদ্যাপিঠে ভর্তি হতে হয়। এবং বাংলাদেশের কোথায় আল-আজহারের শাখা রয়েছে! সে পর্বটির নোটিফিকেশন পেতে ফলো করেুন আমাদের ফেইসবুজ পেজ facebook.com/holymediaupdate । আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটিও সাবস্ক্রাইব করে রাখতে পারেন । ধন্যবাদ।

আরও পড়ুনঃ মোবাইলে রেকর্ড শুনেই এক বছরে কোরআনে হাফেজ হলেন দৃষ্টিহীন তালহা!

Share.

Leave A Reply