প্রকৃতি, পরিবেশ আল্লাহর অপার দান। মাটি, পানি, গাছ, পশু, পাখি, পোকামাকড় সব কিছুর কী সুন্দর সহাবস্থান। যে যার মতো প্রকৃতিতে অবদান রাখছে।
যার নির্দেশে তারা কাজ করছে। যিনি সব কিছুকে সুন্দরভাবে চালাচ্ছেন। তিনি মহান রাব্বুল আলামিন। আল্লাহর এ সৃষ্টি, তার মধ্যে কত কিছু শিক্ষণীয় আছে।
আমরা তা যেন দেখেও দেখি না। অথচ সৃষ্টি নিয়ে ভাবলে ইমান পোক্ত হয়। আল্লাহভীতি জোরালো হয়। প্রকৃতিতে যত প্রাণী আছে। কোনো না কোনোভাবে তা মানুষের উপকারে আসছে। বিষধর সাপ, তা-ও কি কম উপকারী। সাপের বিষে হয় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ। দাঁড়াশ সাপ ইঁদুর খেয়ে ফসল রক্ষা করে। কারণে-অকারণে আমরা এসব প্রাণীকে হত্যা করি। যখন-তখন গাছ কাটা তো কোনো ব্যাপারই না। পাখি শিকার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
অথচ এর কোনোটাই ইসলাম সমর্থিত নন। ইসলাম পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্ব দেয়। বিশ্বনবি (সা.) ছিলেন সবচেয়ে বড় পরিবেশবিদ। উম্মতকে তিনি গাছ লাগাতে উৎসাহিত করেছেন। প্রায় পনেরোশ বছর আগে তিনি যেটা বলেছেন। যার গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন। আজও আমরা তা বুঝতে বড়ই অক্ষম।
নবি (সা.) জনৈক ব্যক্তি গাছের পাতা ছিঁড়লে বলেন, প্রত্যেকটি পাতা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে প্রিয়নবি (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে অথবা খেত-খামার করে, অতঃপর তা মানুষ, পাখি কোনো জন্তু ভক্ষণ করে, তা তার জন্য সদকার সওয়াব হবে।’ (মুসলিম, ৫৫৩২)। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবি কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে, কেয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি লাগাবে।’ (মুসলিম, ৫৫৬০)।
এভাবে অনেক হাদিসে নবিজি (সা.) গাছ লাগাতে উৎসাহিত করেছেন। শুধু কি তাই। পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পাখি। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে।’ (বুখারি : ৫১৯৫)। পশু-পাখিকে অহেতুক নিশানা বানানো ইসলামে নিষিদ্ধ।
আল্লাহর জমিনে তাদের অবাধ বিচরণের সুযোগ দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহেতুক কোনো চড়ুই পাখি মেরে ফেলল, কেয়ামতের দিন পাখিটি আল্লাহর কাছে এই বলে নালিশ করবে যে হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তি আমাকে অহেতুক হত্যা করেছে।’ (নাসায়ি, ইবনে হিব্বান)।
যেসব প্রাণী প্রতিপালন করা হয়, সেগুলোর সুস্থতা ও খাবার দাবারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ওয়াজিব। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘এসব বাক্শক্তিহীন প্রাণীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।
সুস্থ অবস্থায় এগুলোতে আরোহণ করো, সুস্থ অবস্থায় আহার করো।’ (আবু দাউদ : ২৫৪৮)। এভাবেই নবিজি (সা.) প্রাণীদের রক্ষার কথা বলেছেন। তাদের সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। কোনো প্রাণীকে লক্ষবস্তু বানানো যাবে না। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানিও না।’ (মুসলিম : ১৯৫৭)।
হজরত সাইদ ইবনে জুবাইর (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার হজরত ইবনে ওমর (রা.) কোরাইশ গোত্রের একদল বাচ্চাকে দেখতে পেলেন যে তারা পাখি শিকার করছে। এটি দেখে ইবনে ওমর (রা.) তাদের পৃথক করে দেন এবং বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে কোনো প্রাণবিশিষ্ট বস্তুকে লক্ষ্যবস্তু বানায়।’ (মুসলিম : ১৯৫৮)। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের গুরুত্ব নবি (সা.) বুঝতেন। যে কারণে অতি ক্ষুদ্র প্রাণী মৌমাছিও তার চোখ এড়ায়নি।
হজরত আবদুর রহমান বিন আবদুল্লাহ (রা.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে এক সফরে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গী ছিলাম। তিনি দেখতে পেলেন, আমরা একটা মৌমাছির বাসা জ্বালিয়ে দিয়েছি। মহানবি (সা.) বললেন, ‘কে এটি জ্বালিয়ে দিয়েছে?’ আমরা নিজেদের কথা বললাম। তিনি বলেন, ‘আগুনের স্রষ্টা ছাড়া কারও জন্য আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া শোভা পায় না।’ (আবু দাউদ : ২৬৭৫)।
বেঁচে থাকার জন্য পানি দরকার। পানির অভাব নেই। তবুও পানির অপচয় করা যাবে না। পানির সুরক্ষায় নবি (সা.) তৎপর ছিলেন। পানির যথেচ্ছ ব্যবহার ইসলাম অনুমোদন করে না। আল্লাহর রাসূল (সা.) একবার সাদ (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন ওজু করছিলেন।
মহানবি (সা.) জিজ্ঞেস করেন, এ অপচয়ের হেতু কী? সাদ (রা.) বলেন, ওজুর মধ্যে অপচয় আছে? মহানবি (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ, তুমি যদি একটি প্রবহমান নদীর তীরেও থাক (তবু সেখানে পানির যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না)।’ (ইবনে মাজাহ)। এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘মানুষের কষ্ট হয়, এমন তিনটি কাজ পরিহার করো। পানির উৎস, চলাচলের রাস্তা ও গাছের ছায়ায় মলত্যাগ করো না।’ (ইবনে মাজাহ)।
দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ, প্রকৃতির উপাদানগুলো সুরক্ষায় নবি (সা.)-এর পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। অথচ আমরা এগুলো যেন ভুলেই গেছি। পরিবেশ দূষণ, প্রাণী হত্যা করে ভালো থাকতে চাচ্ছি; যা আদৌও সম্ভব নয়। বরং নবি (সা.) নির্দেশিত পরিবেশ বিধিবিধান আমাদের মেনে চলা উচিত। তাহলে এ পৃথিবী সুন্দর বাসযোগ্য হবে।
