মুর্শিদকুলি খান থেকে শুরু করে সিরাজউদ্দৌলা, যুগে যুগে ভারতবর্ষ শাসন করেছেন অনেক নবাব, তাদের একজন ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব।বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন সিরাজউদ্দৌলা । এরপর ব্রিটিশদের শাসন শোষণ চলে বাংলায় বহুকাল। এরপর জমিদারি আলম। সেই থেকে এখন দেশ চলে সরকার প্রধানের সিদ্ধান্তে।
ইতিহাস আর ঐতিহ্য এখনো জানান দেয় সেই সময়কার রাজা বাদশাদের জীবনযাপন সম্পর্কে। তাদের জীবন যে বেশ আয়েশে কেটেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজ্য, রাজত্ব, গোমস্তা, পেয়াদা নিয়ে তাদের আলিশান জীবন। নিজেদের আখের গুছিয়ে, আমোদ-ফূর্তিতে জীবন কাটিয়েছেন রাজা বাদশাহরা। অনেক রাজাই প্রজাদের কথা চিন্তা করেননি। বংশ পরম্পরায় পাওয়া রাজত্ব চালাতে গিয়ে হয়েছেন অমানবিক।
ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি চর্চিত বাদশা সম্রাট শাহজাহান। দিল্লির তাজমহল কখনো ভুলতে দেয়নি শাহজাহানকে। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন তাজমহল। যা বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি। সারাবিশ্বের মানুষ আসেন সেই তাজমহলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে, সাক্ষী হন এক অমর প্রেমের উপাখ্যানের।
তবে জানেন কি? সম্রাট শাহজাহান ও তার স্ত্রী মুমতাজ মহলের তৃতীয় সন্তান ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। যিনি মানবিকতার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন ইতিহাসে। বাদশাহর আয়েশি জীবন তো দূরের কথা জীবিকা নির্বাহ করতেন কোরআন লিখে আর টুপি সেলাই করে। রাষ্ট্র ও জাতির রাজকোষ থেকে নিজের জন্য এক কানা কড়িও গ্রহণ করা বৈধ মনে করতেন না।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ৪৯ বছর ধরে উপমহাদেশ শাসন করেছেন। ভারতবর্ষের প্রায় সব জায়গা তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। আওরঙ্গজেবের সময়েই বাংলার সুবেদার ছিলেন শায়েস্তা খান। তার সময়ে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত।
তার পুরো নাম আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর। ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর গুজরাটের দাহোদে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
পিতা সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। দয়ালু ও অত্যন্ত সাহসী ছিলেন তিনি। ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মে, এক সামরিক পাগলা হাতি তাকে আক্রমণ করে। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে গদা জাতীয় অস্ত্র দিয়ে হাতির শুঁড়ে আঘাত করে নিজেকে রক্ষা করেন।
এই ঘটনার পরই সম্রাট শাহজাহান তাকে বাহাদুর খেতাব দেন। সেই সঙ্গে দুই লাখ রুপি পুরস্কার দেন আরঙ্গজেবকে। এই ঘটনার স্মরণে ফারসি ও উর্দু ভাষায় পংক্তিমালার মাধ্যমে আরঙ্গজেব বলেছিলেন, যদি সেদিন হাতির সঙ্গে যুদ্ধটা আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হতো তাহলে কোনো লজ্জা ছিল না। এতে কোনো অগৌরবের কিছু নেই। লজ্জা সেখানে যা ভাইয়েরা আমার সঙ্গে করেছে।
অন্যান্য সম্রাটদের মতো বিলাসি জীবনযাপন করেননি সম্রাট আওরঙ্গজেব। বলতে গেলে পুরো ভারতবর্ষই ছিল তার আওতাধীন। একজন বাদশাহ যে কতটা দয়ালু হতে পারেন তার উদাহরণ সম্রাট আলমগীর। সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করেছেন। তিনি সবসময় প্রজাদের খোঁজ খবর রাখতেন। তাদের ভালো মন্দ নিজে গিয়ে তদারকি করতেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব তার বাদশাহীকে আল্লাহ পাকের পবিত্র অবদান ও সরকারি কোষাগারকে আমানত মনে করতেন। ঐতিহাসিক লেনপুল লিখেছেন, আওরঙ্গজেব ছিলেন ইনসাফ ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। তার ৫০ বছরের শাসনকালে তার কাছ থেকে জুলুম ও বেইনসাফের কোনো একটি কাজও প্রকাশ পায়নি। অত্যন্ত পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন বাদশাহ আলমগীর।
দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমাতেন। স্মৃতিশক্তিও ছিল খুবই প্রখর। সিংহাসনে আরোহনের পর নানা কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তবুও কোরআন পড়তে ভুলে যেতেন না একদিনও। কোরআন মুখস্তও করে ফেলেছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। নিজে হাতে কোরআন লিখতেন। তার অনবদ্য রচনা ফতোয়ায়ে আলমগীরী এখনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে অনেক যত্নসহকারে পড়ানো হয়ে থাকে। এটিকে শরিয়াহ আইন এবং ইসলামি অর্থনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সম্রাট আওরঙ্গজেব মৌলিকভাবে একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন। শাসক হিসেবে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করতেন। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের ব্যাপক অগ্রগতি করেছেন। শরীয়তের পরিপূর্ণ প্রবর্তন ছিল তার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে কখনো ত্রুটি করেননি। যাবতীয় ইবাদত বন্দেগীর প্রতি তিনি সম্মান প্রদর্শন করতেন।
এতো বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচুঁ স্তরের মুত্তাকি ও খোদাভীরু ব্যক্তি। ফরজ নামাজ ছাড়াও তিনি নফল ইবাদত করতেন। রমজানের ফরজ রোজা ছাড়াও নফল রোজা রাখতেন। কমপক্ষে প্রতি সপ্তাহে তিনটি রোজা অবশ্যই রাখতেন।
তিনি রাজ কোষাগার থেকে নিজের খরচ নিতেন না কখনোই। এমনকি তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন তাকে তার দৈনিক ভাতা হিসেবে পাঁচশত রুপি দিতেন সম্রাট শাহজাহান। সেই অর্থ তিনি কখনোই নিজের বিলাসিতায় খরচ করেননি। তিনি এসব অর্থ ধর্ম ও ইতিহাস শিক্ষার পেছনে খরচ করতেন।
অন্যান্য সম্রাটদের মতো তিনি মুদ্রার উপরে কোরআনের আয়াত লেখার বিরোধী ছিলেন। কারণ মুদ্রা প্রায়শই হাত ও পায়ের স্পর্শ এ আসতো। তার আমলে মুদ্রার একপিঠ এর মুদ্রার প্রচলন এর সাল ও অপর পিঠে একটি দ্বিপদী কবিতা থাকতো। সেখানে লেখা ছিল বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীর, স্বাক্ষরিত মুদ্রা এই দুনিয়ার বুকে একটি পূর্ণ চন্দ্রের ন্যায়।
অগ্রজ শাসকগণের মতো অত্যধিক বিলাসিতা, বেপরোয়া জীবনযাপন পরিহার করে ইসলামের মহান চার খলিফাগণের জীবন-আদর্শকে বুকে ধারণ করে জীবন অতিবাহিত করেন তিনি। রাজত্বের বেশির ভাগ সময়ই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ার পিঠে কাটান। রাজধানীতে থাকা তার পক্ষে খুব কমই সম্ভব হয়েছিল। তিনি উত্তর ভারতের পাশাপাশি সমগ্র দক্ষিণ ভারতে মুঘল বিজয় পতাকা উত্তোলনকারী প্রথম শাসক।
১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ আহমেদ নগরে ৮৯ বছর বয়সে আওরঙ্গজেব মৃত্যবরণ করেন। সংসার জীবনে বাদশার ছিল দুইজন স্ত্রী। একজন ছিলেন রাজপুরী জারাল রাজপুত রাজকন্যা নবাব বাই বেগম। ১৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের সাফাভী রাজকন্যা দিলরাস বানু বেগমকে (অন্য নাম রাবিয়া-উদ্-দুররানি) বিবাহ করেন। তাদের ঘরে জন্ম নেয় বাদশার পাঁচ পুত্র এবং দুই কন্যা।
নবাব বাই বেগমের ঘরে ছিল দুই পুত্র মুহাম্মদ সুলতান, বাহাদুর শাহ প্রথম আর কন্যা বদর-উন-নেসা। আর দিলরাস বানু বেগমের ছিল দুই পুত্র আজম শাহ, সুলতান মুহাম্মদ আকবর আর এক কন্যা জেব-উন-নেসা। অন্য এক পুত্র মুহাম্মদ কাম বক্স ছিল আওরঙ্গবাদী। যিনি ছিলেন বাদশাহর উপপত্নীর সন্তান।
আওরঙ্গজেব তার পূর্বসূরীদের তুলনায় অনেক অনাড়াম্বর ছিলেন। মৃত্যুর পরে তার সম্পদের হিসাব করে পাওয়া যায় ৮০৫ টাকা। যা নিজ হাতে বোনা কিছু টুপি ও নিজ হাতে লেখা কোরআন বিক্রি করে পেয়েছিলেন। এর মধ্যে মাত্র চার টাকা আট আনা তার কাফন দাফনে ব্যয় করার জন্য রেখে অবশিষ্ট অর্থ দান করে দেয়ার জন্য অসিয়ত করে গিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের ষষ্ঠ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব এতটাই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তাকে বলা হত ‘জিন্দা পীর’। তার খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতার কারণেই তিনি সাধারণ গণমানুষের কাছে ‘জিন্দা পীর’ হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেন।
আওরঙ্গজেব ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি পছন্দ করতেন। তার শাসনামলে লাহোরের বাদশাহী মসজিদ এবং আওরঙ্গবাদে তার স্ত্রী রাবিয়া উদ দুরানির স্মরণে বিবি কা মাকবারা নির্মাণ করেছিলেন। ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি চর্চায় আওরঙ্গজেব পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
বিশেষ করে শিল্পী সাঈদ আলী তাবরেজীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আওরঙ্গজেব তার পিতার মতো স্থাপত্যে আগ্রহী ছিলেন না। দিল্লির লাল কেল্লার ভিতরে তিনি মোতি মসজিদ নামে একটি মার্বেল পাথরের মসজিদ তৈরি করেছিলেন। তিনি লাহোরে বাদশাহী মসজিদ নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
শাহী পরিবারের ফরাসি চিকিৎসক ফান কুইজ বার নিয়ার এর বর্ণনায় পাওয়া, মুঘল সাম্রাজ্যের আমলে ভারতের বস্ত্র শিল্প সুদৃঢ় অবস্থানে উন্নত হয়েছিল। সে সময় বিভিন্ন কারখানায় বুটিদার রেশমি কাপড়, সিল্ক এবং অন্যান্য দামি মসলিন প্রস্তুত হতো। এতে করে কারখানাগুলোতে শত শত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল।
তথ্যসূত্র জাগোনিউজ