ভূমিকম্প একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। প্রতি ৩০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ভূমিকম্পন হচ্ছে। অধিকাংশ সময়েই মানু সেই ভূমিকম্প টের পান না। ভূকম্পেনের মাত্রা রেখটার স্কেল ৩ এর বেশী হলেই কেবল টের পাওয়া যায়। আর ৭ এর বেশী হলে গোটা একটি শহর তলিয়ে যেতে পারে। ঘটতে পারে প্রলয়, হতে পারে লাখ লাখ প্রানহানি।
পৃথিবীর ভূকম্পন প্রবন দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জাপান। একারনেই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের অধিকাংশই হয় জাপানে। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে কুক্ষ্যত ভূমিকম্প জাপানে না হয়ে আঘাত হেনেছিলো চিলিতে। ভূকম্পন বিশেষজ্ঞদের মতে ১০০০টি পারমানবিক বোমা পাটালে যে ধংসযজ্ঞের সৃস্টি হয় সেই একই পরিমান শক্তি নিয়ে ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছিলো চিলির বুকে।
ইতিহাসে এমন অনেক ভয়াবহ ভূমিকম্পের নজির রয়েছে।
১. ভালদিভিয়া-চিলি
১৯৬০ সালের ২২ মে, চিলির ভালদিভিয়া অঞ্চলে প্রায় ৯ দশমিক ৫ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পটির শক্তিমত্তা ছিল প্রায় ১৭৮ গিগাট্রন যার স্থায়ীত্ব ছিল প্রায় ১০ মিনিট । ইতিহাস কুক্ষ্যাত এই ভূমিকম্পের আর্থিক ক্ষতি হয় এক বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ। হাজার হাজর মানুষের প্রাণহানি ঘটে, বাস্তুহারা হয় ২০ লাখ মানুষ ।
২. তোহোকু ভূমিকম্প- জাপান
২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের উপকূলে একটি বিশাল সমুদ্রের তলদেশে মেগাথ্রাস্ট ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৯ দশমিক শূন্য ৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পে ১৫ হাজার ৮৭৮ জন মানুষ মারা যায়। হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। নিখোঁজ হন ৩ হাজারেরও অধিক মানুষ। সেসময় জাপানের বিমানবন্দর, সড়ক ও রেলপথ ধ্বংস হয়েছে, ২৯০টি ভবন সম্পূর্ণভাবে ধসে গেছে। ৭৮৮টি ভবন অর্ধেকটি ধসে পড়ে। ৯৮৯টি ভবন আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর জেরে কানাডা এবং হাওয়াইয়েও ছোঁয়া লাগে।
৩. রাশিয়া
১৯৫২ সালের ৪ নভেম্বর বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়। ঘটনাটি ঘটে রাশিয়ার কামকাটকা উপদ্বীপে। এটি ৫০ ফুট পর্যন্ত ঢেউসহ একটি দুর্দান্ত ধ্বংসাত্মক প্রশান্ত মহাসাগরীয় সুনামি তৈরি করেছিল। আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। এ ছাড়াও রাশিয়ার কামকাটকা উপদ্বীপে অনেক আগ্নেয়গিরি সক্রিয় ছিল এবং এখানে ১৯২৩ সালে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাত হেনেছিল।
৪. সুমাত্রা ইন্দোনেশিয়া
২০০৪ সালে ২৬ ডিসেম্বর; ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ৯ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ইন্দোনেশিয়ার সামাত্রা প্রদেশে আঘাত হানে। অনেকে একে ক্রিসমাস বা বক্সিং ডে সুনামি নামেও চেনেন। ভূমিকম্পের ২০ মিনিট পর, ভারত মহাসাগর থেকে ১০০-ফুট উচ্চতার প্রলয়ঙ্করী ঢেউ উপকূল অঞ্চলগুলোয় আছড়ে পড়ে। নিমিষে পানির নিচে তলিয়ে যায় সুমাত্রা অঞ্চল। এর প্রভাব পড়ে ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ডেও। এতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ রাতারাতি মারা যায়। অন্তত সাত বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৫. তাংসান চীন
১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই; গভীর রাতে হঠাৎ ৮ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে চীনের তাংসান এবং হেবেই অঞ্চলে। ওই ভূমিকম্পটি আড়াই গিগাট্রন শক্তিমত্তা নিয়ে আঘাত হানে। মাত্র দশ সেকেন্ডের ভূমিকম্পে পুরো একটি অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যায়। ২৩ সেকেন্ডের স্থায়ীত্ব ওই ভূমিকম্পে তাংসানের ৯০ শতাংশ অকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে চীন সরকার প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী সেদিন প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।
৬. শানসি চীন
১৫৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারিকে চীনের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে লেখা হয়েছে। সেদিন চীনের শানসি প্রদেশকে কেন্দ্র করে মোট ৯৭টি দেশে একযোগে আঘাত হেনেছিল ভয়ংকর এই ভূমিকম্প। ৮ দশমিক শূন্য মাত্রায় হওয়া কয়েক সেকেন্ডের এই ভূমিকম্পটির শক্তিমত্তা ছিল এক গিগাট্রন। এতে প্রায় সাড়ে আট লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। শক্তিশালী ভূমিকম্পটি পাহাড় সমতল করে দেয়। নিভে যাওয়া আগ্নেয়গিরি আবারও প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়, এমনকি নদী তার গতিপথও পরিবর্তন করে ফেলেছিল। এর প্রভাবে পৃথিবীতে ৬৬ ফুট গভীর পর্যন্ত ফাটল দেখা গিয়েছিল।
৭. আলেপ্পো সিরিয়া
সময়টা ১১৩৮ সালের ১১ অক্টোবর। সিরিয়ার প্রাচীনতম আলেপ্পো শহরে তখন মাত্র ভোর হতে চলেছিল। ঠিক তখনই ৮ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প প্রায় ৩ গিগাট্রন শক্তি নিয়ে নাড়িয়ে দেয় ঐতিহাসিক নগরী আলেপ্পোকে। ভূমিকম্পের ইতিহাসে এটিকে বলা হয় চতুর্থ ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। গোটা একটি শহর মিশে যায় মাটির সঙ্গে। আলেপ্পোর দুর্গের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং স্থানীয় অসংখ্য বাড়িঘর ধসে পড়ে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো আলেপ্পোর ওই সকালে একটি গির্জায় প্রাতকালীন প্রার্থনারত ৬০০ মানুষ মারা যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, ওই ভূমিকম্পে আড়াই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।
৮. দামহান ইরান
৮৫৬ সালের ২২ ডিসেম্বর। তৎকালীন ইরানীয়রা ৭ দশমিক ৯ মাত্রার এক ভয়ংকর ভূ-কম্পনের সাক্ষী হয়। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর দামহানে এই ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। ৩৫০ কিলোমিটার বা ২২০ মাইল এলাকাজুড়ে তান্ডব চালায় ওই ভূমিকম্প। ধ্বংস করে অসংখ্য জনপদ। ইরানে সেদিন ২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। দামহান পার্শ্ববর্তী বিখ্যাত বাসৃতাম নগরী পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
৯.হাইজুয়ান চীন
১৯২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর; চীনের গানসু প্রদেশকে ধ্বংস করে দেয় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্প। তৎকালে চীন স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিধসের মুখোমুখি হয়েছিল। গ্রাম থেকে শহর; সব বাড়ি-ঘর মাটির সঙ্গে মিশে যায়। সেবার ৬৭৫ বার রেকর্ড পরিমাণ ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। আনুমানিক ১ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায় কেবল ভূমিধসের কারণে। তৎকালীন চীনা সরকার জানিয়েছে, ২ লাখ ৭৩ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।
১০. হাইতিয়ান হাইতি
সময়টা ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি,ঘড়ির কাটায় তখন বিকাল ৪:৫৩ মিনিট। সেময় প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র হাইতি। প্রাথমিকভাবে ভূমিকম্পটি ৭ মাত্রায় আঘাত হানে। তবে পরবর্তীতে দুটি আফটার শকে কেঁপে ওঠে গোটা ক্যারিবীয় দ্বীপ অঞ্চল। এর কয়েকদিন পর ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকে আফটার শক্। ভয়ানক এই ভূমিকম্প কেবল হাইতি এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র নয়, প্রতিবেশী কিউবা, জ্যামাইকা এবং পুয়ের্তো রিকোতেও অনুভূত হয়। জানা গেছে, সে সময় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ কয়েক মাস গৃহহীন কাটিয়েছিলেন। ৩ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।
এছাড়াও ইতালি, জাপান, তুরস্ক, আফগানিস্তান, তুর্কেমিনিস্তান, কাশ্মীর ও আজারবাইজানে বিভিন্ন সময়ে প্রলয়ংকারি ভূমিকম্প আঘাত হানে।
আরও পড়ুনঃ ভূমিকম্প সম্পর্কে কোরআন-হাদিসে যা বলা হয়েছে (ভিডিও)